প্রবাস জীবনে প্রায় আড়াই বছর হতে চললো। এরমধ্যে গত দেড় বছর ধরে যে বাড়িটায়(বাড়ি না বলে অ্যাপার্টমেন্টে বা রুম বলা উচিত) থাকছি তার পাশেই বিশাল আয়তনের গোরস্থান। সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো চরাচর জুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতার মাত্রা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেয় এসব দীর্ঘ হিম রাত্রি। সারাদিন বাসায়ই বসে থাকা হয়। বাইরে বের হবার জো নেই। উষ্ণ বিছানার আহবানে শুয়েও পড়ি সাজ বাতি না নিভতেই। কিন্তু শীতের দীর্ঘ রাত্রির অবসান হয় না।
মাঝরাত পেরিয়ে ঘুম ভেঙে গেলে জানালায় চোখ পড়ে সবার আগে। সারাদিন তুষারপাত হয়েছে আজ। দূরের-কাছের বাড়ির ছাদে-কার্নিশে, রাস্তায়-পার্কংয়ে শুভ্র তুষার জমে আছে। আকাশও পরিষ্কার। কিন্তু আজ বোধহয় আকাশে চাঁদ নেই। থাকলেও এপাশটা থেকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু বাইরের শুভ্রতায় রাস্তার আলোর প্রতিফলনে কিছুই দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। দেখার মত তেমন কিছু নেই যদিও। তাও বাইরে তাকিয়ে আছি। রাস্তায় গাড়ি বা মানুষ নেই কোন। তাও ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে, লাল-সবুজ-হলুদ-নীল। ল্যাম্পপোস্টে নীল আলো আসলো কোথা থেকে? কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নীল আলো। শুনেছি এলএসডি ড্রাগ নিলে এমন কিছু রং দেখা যায় যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। আমি এলএসডি নেইনি, তবে এক বড়ভাই তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, নতুন কোন রং দেখতে পাওয়া যায় না, পৃথিবীর রংগুলোই আরও মোলায়েম হয়ে আসে। নীল রংটা কি মোলায়েম? ইউনিভার্সিটিতে হিউম্যান-কম্পিউটার ইন্টারঅ্যাকশন কোর্সে পড়েছিলাম প্রতিটা রঙয়ের আলাদা আলাদা মানে আছে। নীল রঙের মানে কি সেটা মনে করার চেষ্টা করি। ভাবনার সুঁতো ছিড়ে যায় দূর থেকে ভেসে আসা কোন গানের সুরে-
“সুদিন.. কাছে এসো, ভালোবাসি একসাথে এই সব কিছুই।”
কার গান মনে করতে পারি না। মনে করবার তাগাদাও নাই। তাগাদা আসে কবিতার। জীবনানন্দ আওড়াতে থাকি-
“হায় চিল, সােনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে।”
চিলের ডানার রং সোনালী হয়? চিল কাদেঁ কেন? কিসের দুঃখ ওর? গানটার নাম মনে পড়ে যায়। মহীনের ঘোড়াগুলোর গাওয়া- হায় ভালোবাসি। হায় চিল! হায় ভালোবাসি! কিন্তু মহীনের ঘোড়াগুলো তো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে। তাহলে ওরা কেন গান গাইবে? এখন কি কার্তিক মাস চলে? না বোধহয়। মাথার ভেতর দপদপানি শুরু হয়। এতো ভাবতে পারি না।
আমি শুয়ে পড়ি। ঘুম আসে না। স্বপ্ন আসে। একটা জলপাই রঙা নৌকায় বুড়িগঙ্গার মাঝে শুয়ে আছি। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সে আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ এসে আমার নৌকাটা ডুবিয়ে দিয়েছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। শরীর ভিজে যাচ্ছে, ঠান্ডা লাগছে। তন্দ্রার ঘোর কেটে যায়। খুলে রাখা জানালাটা থেকে তুষার এসে পড়ছে মুখের উপর। সাউন্ড সিস্টেমে তখনও বেজেই চলেছে-
“ভালোবাসি পিকাসো, বুনুয়েল, দান্তে
বিটল্স্, ডিলান আর বেথোফেন শুনতে।
রবিশঙ্কর আর আলি আকবর শুনে
ভালোবাসি ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফিরতে।”
জানালাটা বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়ি। বদ্ধ ঘরে দম বন্ধ লাগতে শুরু করে। হাসফাস করতে থাকি। মনের ভেতরকার শব্দজটটা খুলে ফেলতে হয়ত শান্তি লাগতো। শব্দগুলোকে সাজালে হয়ত একটা গল্প হতো। সেই গল্প হয়ত মানুষ বুঝতে পারতো। কিন্তু প্যাঁচ লেগে থাকা শব্দগুলো আওড়াতে গিয়ে মনে হয় কবিতা হয়ে যায়। সব মানুষ কি কবিতা বুঝে? কবিতা হলো ঐশ্বরিক বাণীর মত। কোরআন-বাইবেল-উপনিষধ-বেদের লেখা সুন্দর সে কথা সবাই জানে, মানে; কিন্তু এসবের অর্থ বোঝে কয়জনে? আমার জমাট বাঁধা কবিতাগুলো আর গল্প হয়ে বেরিয়ে আসে না। ভেতরে ভেতরে পচতে থাকে। সে পচন ছড়িয়ে পড়ে আত্মায়। ভেতর থেকে তখন কেউ প্রশ্ন করে-
মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় নাকি গান গায়?
ছবি: ফেসবুক(কবি জীবনানন্দ দাশ চত্বর)