গতবছর যখন কেমনিটজ এসেছি তখন ঠিক ক্রিসমাসের আগের মুহূর্ত। শরতকে বিদায় জানিয়ে মাঘের সন্যাসী আসি আসি করছে। রংবেরঙের মৃতপ্রায় পাতায় গাছে গাছে যেন আগুন লেগে আছে। হলুদ-কমলা রঙেরও যে এত রকম রঙবিন্যাস হতে পারে এখানে না আসলে বোধহয় জানাই হতো না। ক্রিসমাসকে ঘিরে চারিদিকে উৎসবের আমেজ। তাছাড়া সদ্য ইউরোপ এসেছি। যা দেখি চোখের সামনে সবকিছুই অকল্পনীয় সুন্দর মনে হয়। কোন চিন্তা নেই, কোন পিছুটান নেই; দিনে গোটা দুয়েক ক্লাস আর বিকেল থেকে রাত অবধি শহরের পথেঘাটে বাউন্ডুলেপনা। বেশ চলছিলো এমনই। এরপর কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধীরে ধীরে নেমে এলো শীত। বাহারী পাতারা অদৃশ্য হলো নিমেষেই। গোটা উপত্যকা পরিনত হলো এক রুক্ষ, শ্রীহীন, বাদামী মরুভূমিতে। বাতাসে এক অদ্ভুত বিষন্নতা।

এত রুক্ষতা আর নিষ্প্রানতার মাঝেও সবচেয়ে বেশী নজর কেড়েছিলো ক্রিসমাসের সাজসজ্জা। ক্রিসমাসকে ঘিরে সাজসজ্জা চলে পুরো ইউরোপ জুড়েই। ঐতিহ্যবাহী খাবার আর বাহারী ক্রাফট নিয়ে ক্রিসমাস মার্কেট বসে মাঝারি - বড় শহরগুলোতে। কিন্তু পূর্ব-জার্মানীর এই অংশটাতে ক্রিসমাস আসে একটু ভিন্নরূপে। ডিসেম্বর শুরু হওয়ার পর থেকেই নগরের বাড়িগুলোর মধ্যে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন চোখে পড়ল। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে সবগুলো বাড়ির প্রতিটি জানালায় চোখে পড়ে অর্ধাবৃত্তাকার একটি করে মোমবাতিদানী যার উপরিপৃষ্ঠের পুরোটাজুড়ে সাজানো থাকে মোমবাতি সদৃশ কিছু ইলেকট্রিক বাতি। কিছু কিছু বনেদী বাড়িতে ইলেকট্রিক বাতির পরিবর্তে মোমবাতিও চোখে পড়ে। এমন একটি বাড়ি তো দূরে থাক, এমন একটি জানালাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এই বাতি জ্বলছে না। সবগুলো মোমবাতি দানীর একই ডিজাইন, একই গঠন; ঠিক যেন এখানকার বাড়িগুলোর মতই। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারিনি। গতবছর কেটে গেলে। এবছর ডিসেম্বর শুরু হওয়ার পরঐ একই রকম সাজ দেখে জার্মান বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম এর ইতিহাস।

কিন্তু সেই ইতিহাস জানতে ফিরে যেতে হবে আড়াইশ বছর আগে কিংবা আটশো বছর আগে। সময়কাল তখন দ্বাদশ শতাব্দী। জার্মানী ও চেক রিপাবলিককে পৃথক করে রেখেছে বোহেমিয়ান পর্বতশ্রেণী, যার বর্তমান নাম ওরে মাউন্টেন। ওরে মাউন্টেনের পশ্চিমে জার্মানীর স্যাক্সোনি রাজ্য, অপরপাশে চেক রিপাবলিকের বোহেমিয়ান রাজ্য। সে সময়কার স্যাক্সোনি জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের ঢাল মাত্র। বস্তুত কোন বসতি তখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই রাজ্যের পরিচালনা পরিষদের সদস্য অটো ভন মাইসেন সিন্ধান্ত নিলেন জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে একটি উপনিবেশ স্থাপন করবেন। তারই ধারাবাহিকতায় ফ্রাইবার্গ সহ বিভিন্ন অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য শ্রমিক নিযুক্ত করলেন। এই জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় ১১৬৮ সালে মাইসেন ক্রিশ্চিয়ানডর্ফ গ্রামে খুজে পেলেন এ অঞ্চলের প্রথম রূপার খনি। শুরু হলো স্যাক্সোনির খনি শিল্পের যাত্রা৷

বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলে দলে সেটেলার এসে ভীড় জমাতে শুরু করলো। উদ্দেশ্য রূপার খনি খুঁজে বের করা। জার্মান ভাষায় যাকে বলা হয় Berggeschrey অর্থাৎ পাহাড়ের গন্ডগোল। আমাদের সত্যজিৎ রায় দেখলে হয়ত গ্যাংটকে গন্ডোগোলের মত স্যাক্সোনিতে গন্ডোগোল নামে কিছু একটা লিখে ফেলতে পারতেন। জার্মান Berg শব্দের অর্থ পর্বত আর Erz শব্দের ইংরেজী অর্থ Ore। বাংলায় অনুবাদ করলে দাড়ায় “প্রাকৃতিক শিলাখন্ড যা থেকে মূল্যবান ধাতু পরিস্রাবণ করা সম্ভব”। পঞ্চাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বোহেমিয়ান পর্বতশ্রেণীর উপত্যকা জুড়ে এত এত খনি আবিস্কৃত হলো যে এর নাম বদলে হয়ে গেলো Erzgebirge বা Ore Mountain- gebirge শব্দের অর্থ পর্বতশ্রেণী।

এরই মাঝে ১৬১৮ সালে মধ্য ইউরোপজুড়ে শুরু হলো বিখ্যাত দ্য থার্টি ইয়ারস ওয়ার। ধারণা করা হয় এই যুদ্ধে মোট জার্মান জনসংখ্যার ৬০% মারা যায়। অর্থনীতি সম্মুখীন হয় এক বিশাল ধাক্কার। ধ্বংসপ্রায় নগরী আর পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে খনিগুলো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে একে একে। কিন্তু প্রচন্ড কায়িক পরিশ্রম দ্বারা মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে আলো মুখ দেখায় খনি শ্রমিকেরা। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারে এরা। প্রায় একশ বছরের মধ্যে খনি শিল্প আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তখনই এ শিল্পের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্য সেভেন ইয়ারস ওয়ার। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে শুরু হওয়া এ যুদ্ধের প্রধান দুই পক্ষ ব্রিটেন ও ফ্রান্স হলেও তার প্রভাব পড়ে পুরো ইউরোপ জুড়েই। ফের শুরু হয় অর্থনৈতিক মন্দা।

এরই মাঝে ১৭৬০ সালে ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় প্রথম শিল্প বিপ্লব৷ চাহিদা বাড়তে থাকে খনি শিল্পের৷ চাহিদা অনুযায়ী জোগান নিশ্চিত করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় খনি শ্রমিকদের। খনি মালিকরা মরিয়া হয়ে ওঠে তাদের একচেটিয়া ব্যবসা টিকিয়ে রেখে অধিক মুনাফা লাভের আশায়। যার প্রভাব পড়ে শ্রমিকদের উপরে।

এ সময় শ্রমিকদের দিনে বারো থেকে পনেরো ঘন্টা কাজ করতর হতো। শীতকালে এ অঞ্চলে সূর্য ওঠে আটটার দিকে, আর অস্ত যায় চারটার মধ্যে। শ্রমিকরা খনিতে প্রবেশ করতো ভোর রাতে, সূর্যোদয়ের আগে। আর যখন ১২-১৫ ঘন্টার পরিশ্রম শেষে খনি থেকে বেরিয়ে আসতো তখন রাত। ফলে পুরো শীতকালে সুর্যের আলো তাদের আর দেখা হতো না। ফলে আক্রান্ত হতো Seasonal Affective Disorder (SAD) বা উইন্টার ডিপ্রেশন নামক রোগে৷ এই রোগে আলো দেখতে না পারার সাথে সাথে বাড়তে থাকত হতাশা আর বিষন্নতা। ধীরর ধীরে দেখা দেয় ক্ষুধা মন্দা, খিটখিটে মেজাজ, অস্বাভাবিক ঘুম আর ওজন বৃদ্ধি। ঘাটতি দেখা দেয় মেলাটোনিন ও সেরোটোনিন নামক হরমোনের। এই হতাশা কাটিয়ে ওঠা মোটেই সহজ নয় যেখানে সারাদিন খনিতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়।

তাই তারা তাদের বাড়ি-ঘরগুলোকে বিভিন্ন আলোক সাজে সজ্জিত করে রাখতো। তারই সূত্র ধরে আসে এই Schwibbogen (শ্রিভবুগেন) যার ইংরেজী অর্থ Candle Arches যার অর্ধবৃত্তাকার অংশটি উপস্থাপন করে খনি প্রবেশপথকে। প্রথম এই ধাতব মোমবাতি দানীর সন্ধান পাওয়া যায় ১৭২৬ সালে জোহান টেলার নামক কামারের কামারশালায়৷ বর্তমানে কাঠ, প্লাস্টিক দিয়ে তৈরী করা হলেও প্রাথমিকযুগে প্রধান উপকরণ ছিলো ধাতু। অর্ধবৃত্তাকার মোমবাতি দানীটির উপরপৃষ্ঠ জুড়ে থাকে বিজোড় সংখ্যক বাতি আর মাঝের অংশটিতে স্থান পায় বিভিন্ন কারুকাজ, যার বেশিরভাগেরই এ অঞ্চলের লোকশিল্পকে উপস্থাপন করে। সবচেয়ে প্রচলিত নকশাতে দেখা যায় এই অঞ্চলের প্রধান তিনটি অর্থ আয়ের উৎসকে- খনি শ্রমিক, কাঠমিস্ত্রী ও তাঁতশিল্প। বর্তমানে এই নকশার বহু রূপভেদ ঘটলেও মূল সংস্কৃতিকে এরা ধরে রেখেছে তিনশ বছর সময় ধরে।