শরীরটা এখনও পুরোপুরি ভালো না। থেকে থেকে ঘাড়ের ব্যথাটা বড্ড ভোগাচ্ছে। সকালবেলা চোখ খোলার পরেও ঘুম থেকে উঠতে আধঘন্টা কখনওবা পুরো ঘন্টা লেগে যায় কখনো। ঘাড়টাকে বিছানা থেকে তুলতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় কিছুক্ষণ। ঘাড় নাড়াতে গেলে কড়মড়ে একটা শব্দ শুনতে পাই। এরপর ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে৷ ডাক্তার অবশ্য বলেছিলো নিয়মিত ব্যায়াম করা ছাড়া আর কোন দীর্ঘস্থায়ী ওষুধ নেই৷ আলসেমি করে সেও ছেড়ে দিয়েছি শীত পড়তে শুরু করেছে পর থেকে। প্রাত্যহিক যুদ্ধ শেষে কফির মোকাটা চুলোর উপর বসিয়ে প্রাতঃকৃত্য শেষ করি। প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যথাটা বোধহয় কফির জন্যই হচ্ছে। তখন কফি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার আস্বস্ত করলো ব্যথার সাথে কফি খাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই৷ তখন থেকে শুরু হয়েছে লিটার লিটার কফি পান৷ কফি হয়ে গেলেই বসে পড়ি টেবিলে।

এরপর সমস্ত দিন কাটে এই টেবিলে বসেই৷ দুপুরে খাওয়ার আগে কয়েকঘন্টা পড়াশোনা হলেও, দুপুরের পরের সময়টা কাটে অলসভাবে। শীত আসার পর থেকে বিকেল-সন্ধ্যা বলে কিছু নেই এখানে। ঘরের বাইরেই যাইনা দিন পাঁচেক হলো। সেই তিন তারিখ বাজার করে যে বাসায় ঢুকলাম এরপরে আর বের হওয়া হয়নি কোথাও। করোনার এই কঠিন সময়গুলো পার করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব সবকিছু অনলাইনভিত্তিক হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাইর বের হওয়া একদমই নিষ্প্রয়োজন হয়ে গিয়েছে। আগে যদিও সপ্তাহে ২ দিন ইন্সটিটিউটে যাওয়ার দরকার পড়তো। আজ ইমেইল পেয়েছি করোনার সেকেন্ড ওয়েভের জন্য সেও সামনের সপ্তাহ থেকে বন্ধ; অন্তত এ বছরের মত। তারমানে এখন পুরো সপ্তাহটাই কাটবে এই ১৪ স্কয়ার মিটারের অ্যাপার্টমেন্টে৷ খাবার-দাবার যা আছে তাতে বেশ কিছুদিন আর বাজার করতে হবে না। কিন্তু মোমবাতি শেষ হয়ে গিয়েছে৷ কিনতে যেতেও ইচ্ছে করেনা, আবার একটু রাত হলেই বৈদ্যুতিক বাতির তীব্র আলোও চোখে অসহ্য লাগে।

যদিও সমস্ত দিনই এভাবে বসে কাটে না। বসে থাকতে থাকতে কোমড়টা চেয়ারের সাথে এঁটে যাওয়ার উপক্রম হলে দরজাটা খুলে বারান্দায় দাঁড়াই অবশ্য। কিন্তু সেটা মিনিটখানেকর বেশি সম্ভব হয় না। পাঁজর কাঁপানো হিম বাতাসে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে আবার ভারী জামাকাপড় পড়তে হবে। সে আর এক যুদ্ধ। আমার বাসাটা ছ’তলায় হলেও বারান্দায় দাড়িয়ে সামনে-ডানে-বামে তাকালে শুধু পাহাড়ের ঢালই চোখে পড়ে। সেখানে সারি সারি পাতাহীন রুক্ষ গাছ আর মিটিমিটি জ্বলতে থাকা বাড়িগুলোই চোখে পড়ে৷ ক্রিসমাসের জন্য বাড়িগুলোতে আলোকসজ্জাও বেশি বোধহয়। প্রথম প্রথম বাড়িগুলোকে খুব আকর্ষণীয় মনে হত। এখন আর তেমনটা মনে হয় না৷ চোখ মানিয়ে নিয়েছে হয়ত। জায়গাটাকে এখন নিজের বাড়ির মতই মনে হয়। এই যে সামনের বাড়িটায় নীল আলো জ্বলছে হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় এই বাড়িটাকে আমি অনেক যুগ ধরে চিনি। মনে হয় প্রতিদিন স্কুল ছুটির পরে এই বাড়িটাতেই কাউকে মাঠে যাওয়ার জন্য ডাকতে যেতাম। কাকে ডাকতে যেতাম নামটা ঠিক মনে করতে পারিনা। তারপরে ওই যে মরা গাছটার পাশে পরিত্যাক্ত দোতলা বাড়িটা পড়ে আছে, ওখানেই কত বিকেল যেন লুকিয়ে সিগারেট টেনেছি।

আবার ক্ষাণিক বাদেই মস্তিষ্কের উপর থেকে পাতলা কুয়াশার পর্দাটা সরে যায়৷ সম্বিৎ ফিরে পাই। এখানে কিছুই আমার নয়, কেউই আমার নয়৷ এই মাটি, আলো, বাতাস- কিছুই না। আমি একটা পরজীবী মাত্র৷ সে তো সব যায়গার জন্যই সত্যি। এই পৃথিবীর কোথাও কি আমার বলে কিছু আছে? ছিল? আমার আমিত্ব তো বিসর্জন দিয়েছি সেই কবেই। সেই যে পর্বতের বাঁকে বাঁকে, হিমালয়ের গিরি কন্দরে, নির্ঝরীনির উত্তাল স্রোতে আমার সমস্ত আমিত্ব সঁপে দিয়েছিলাম সে কি আর ফিরে আসে? মাঝে মাঝে পরিচিত জনেরা প্রশ্ন করে এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চাই কিনা। সে আমিও আমাকে প্রায়শই করি। কিন্তু আমি আমাকে জানি। কালপুরুষের যে ভয়ংকর ছায়া আমার উপরে পড়ছে তাতে কোথাও স্থায়ী হওয়া বোধহয় কখনোই হবেনা আমার। যতদিন ভালো লাগবে ততদিন এখানে থাকবো। যেদিন আর ভালো লাগবে না সেদিন অন্য কোথাও চলে যাবো। কোথায় যাবো তাও জানিনা।

যদিও প্রায়শই, বিশেষ করে এই শীতের রাতগুলোতে, ভোরগুলোতে আমার কিছু যায়গার কথা মনে পড়ে। শেষবার যখন নিঝুম দ্বীপ গিয়েছিলাম সেটা মনে বেশ পড় একটা দাগ কেটে আছে৷ লঞ্চের ছাদে তাবু ফেলে মাঝরাতে শীতে কাচুমাচু করা, হাতিয়ায় কিছু নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, সেদিনকার সূর্যাস্ত, সবকিছুই চোখের সামনে ভাসতে থাকে৷ সেবারের মত করে নিজের সঙ্গ আর কখনো উপভোগ করেছি কিনা মনে করতে পারিনা। তারপরে যেবার যশোর গেলাম। মাঝরাতে ভারী কুয়াশার মাঝে বাস নামিয়ে দিলো গতখালি৷ এই কুয়াশা আর বৃষ্টি দেখতেই বার বার বাংলাদেশে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়৷ তারপর সারাদিন যশোরে টো টো করে পরদিন মাঝরাতে আবার নাটোর৷ নাটোর জীবনানন্দকে কতটা শান্তি দিয়েছিলো জানিনা। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের “একবিন্দু শিশিরের জন্য মারা যাওয়া” ব্যাপারটা আমাকে নাটোরই উপলদ্বি করিয়েছিলো৷ সেই ভবঘুরে জীবনটা আর কখনো ফিরে আসবেনা মনে হলেই মনটা হু হু করে ওঠে৷ হালতির বিলে কোন এক স্নিগ্ধ সকালে শিশিরভেজা দিগন্তজোড়া মাঠের উপর আর কোন একদিন না হেঁটেই মারা যাবো ভাবতেই মনটা ভারী হয়ে ওঠে। আমার জীবনে অজস্র অব্যবহৃত দিন পড়ে আছে। এই দিনগুলোর পরিবর্তে যদি “একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা” কিংবা “একটি শীতের সকাল” কিনতে পারতাম তবে এখনই কিনে ফেলতাম।

কিন্তু সে আর কখনোই কেনা যাবে না। জীবনটাকে গুছিয়ে ফেলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই গুটিয়ে ফেলেছি এক রুক্ষ শীতল মরুভূমির মাঝে। এর থেকে আমার আর কোন নিস্তার নেই৷