সামনের গিরি শিরায় চোখ রেখে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটা নীল, ক্লিওপেট্রার চোখের মত নীল। সে চোখের মাঝে সাদা মনির মত দগদগ করছে ম্যাটারহর্ন। সামিট পিরামিডটা ঢেকে রয়েছে পাতলা মশারীর মত মেঘে। মেঘটা খানিক আগেও ছিলো না। জীবনানন্দের বিপন্ন বিস্ময়ের চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছি। ভাবিনি আবার কোনদিন পর্বত হাতছানি দিবে, আবার কখনও পাথুরে পথে আমার পদচিহ্ন পড়বে। আমি তো ভেবেছিলাম পর্বত আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে ইট, পাথর আর কংক্রিটের নর্দমায়। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।

শুনেছিলাম পাহাড় ভাগ্যবানদের হাতছানি দেয়। ভাগ্যজোড়েই হোক কিংবা কোন পুণ্যের বদৌলতেই হোক, পর্বত আমাকেও হাতাছানি দিয়েছিলো, ভালোবাসতে শিখেয়েছিলো; শিখিয়েছিলো অধ্যবসায়, শ্রদ্ধাবোধ; বেঁধেছিলো মায়ায়। তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনা দিয়ে অনুরণিত করেছিলো আমার প্রতিটি নিউরনকে। আমার খুব একটা পাহাড়ে হাঁটা হয়নি। অন্তত যতটা ইচ্ছে ছিলো তার যৎসামান্যও নয়। কিন্তু আমার পর্বত নিয়ে জানতে ভালো লাগতো। আদিম জীবনধারা, হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা সবকিছুই যেন খুঁজে পেতাম উপত্যকাজুড়ে৷

একটা সময় প্রতিবছরের পর্বতভিযানগুলোর খোঁজ রাখা হতো, এবছর এভারেস্টের সিজন কবে থেকে শুরু হয়েছে, কোন দেশ থেকে কতজন পারমিট পেয়েছে? এবারে কারাকোরাম রেঞ্জে পোলিশ টিমের সফলতার সম্ভাবনা কতটুকু? ফ্রেডরিক স্ট্রাং কি আবারও কে টু তে যাবেন? পাতাগোনিয়ায়ই বা কি হচ্ছে? অ্যালেক্স কি নতুন কোন পরিকল্পনা করছে ইয়োসেমিতি নিয়ে? সবকিছু জানা একটা নেশার মত হয়ে গিয়ছিলো।

এরপর একদিণ হঠাৎ করে সবকিছুতে যেন একটা ছন্দপতন ঘটে গেল। ঢাকা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টগামী বিমানে যেদিন চড়ে বসলাম সেদিনই। ঝাপসা চোখে বিমানের জানালায় চোখ রাখলেই বারবার ভেসে উঠছিলো চড়াই উঠে যাওয়া একসারি পাইন বন। তারও উপরে কালচে স্লেট পাথরে জমে থাকা শুভ্র তুষার। ইঞ্জিনের গমগম শব্দকে মনে হচ্ছিলো উত্তাল কোন নির্ঝরিণীর প্রবাহ পথ। আর কোন দিন কি হিমালয় ছুঁয়ে আসা বরফ শীতল বাতাস পাঁজরে কাঁপন ধরাবে? আর কোনদিন কি খাদের কিনারায় তাঁবুর ভেতরে স্লিপিং ব্যাগে অলস শরীরটাকে গলিয়ে দিয়ে বৃষ্টি দেখা হবে?

ভাগ্যক্রমে বৈদেশে আমার বসবাসের যায়গা হলো চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত এক ছোট্ট উপত্যকায়। কালো গ্রানাইট বা ব্যাসল্ট পাথরের সুইচ্চ পর্বত নয় বটে; টিলার মত দীর্ঘ ঢালের নরম ঝুরঝুরে মাটির পাহাড়। এখানে বসন্তে সরিষা, গ্রীষ্মে গম-যবের চাষ হয়। শীতে ঢাকা পরে পুরু তুষারে। শীতের রাতে রুমের জানালা থেকে হিটারের পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকি। জোসনায় ভেসে যায় চরাচর। শীতে ঘুরে আবার বসন্ত আসে। কিন্তু পাহাড় আর আমাকে ডাকে না। কোন অপরাধে আমার থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিলো ভাবতে ভাবতে বিষন্ন লাগে। অবসন্ন বিকেলগুলোতে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলতে থাকে দ্বিচক্রযান। শরতের ঝরা পাতা পেরিয়ে হাঁটতে থাকি দিকবিদিকশুন্য। কিন্তু পাহাড় আর হাতছানি দেয় না। নিজেকে দুর্ভাগা মনে হতে থাকে।

এরপর আসে সেই দিন। মাসখানেক আগে ইন্টার্নশিপ, পরীক্ষা, প্রজেক্ট আর পেপার লেখার ক্রমাগত চাপে যখন নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে তখনই টের পেলাম সে ডাকছে। এ বহু পুরোনো পরিচিত আহ্বান। একে এড়িয়ে যাওয়া ক্ষমতা আমার নেই। শুধু আমার কেন, বিশ্বসংসারে কারোরই নেই। যে ডাকে সাড়া দিয়ে জন মুর বলেছিলো, “The Mountains are Calling and I Must Go”; জর্জ ম্যালরী বলেছিলো, " Because It’s There”, সেই আদিম আহ্বান। হাতের কাছেই আল্পস। চাইলেই সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে আল্পসের কোন পর্বতের পাদদেশে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার মত অর্বাচীনের জীবন যে ছকে বাঁধা। চাইলেই বাক্সের বাইরে বেড়িয়ে যাওয়া যায় না। তাছাড়া এত দীর্ঘ বিরতি। প্রস্তুতিরও কিছু ব্যাপার রয়ে যায়।

ছবিতে ম্যাটারহর্ন প্রথম দেখেছিলাম ২০১৬-১৭ এর দিকে, পর্বত নিয়ে কোন এক ডকুমেন্টারিতে। তখন পর্বতের উচ্চতা নিয়ে খুব একটা অক্ষরজ্ঞান ছিলো না। শুধু মাত্র গঠন-আকৃতি দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর বহুবার সুইশ আল্পসের এই দানোকে নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখেছি, পড়াশুনা করেছি। কিন্তু তার কাছে পৌছানোর, ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য কোনদিন হতে পারে বলে কল্পনাও করিনি। হাতের কাছে সুযোগ যখন আছে তার সদ্ব্যবহার করতে ক্ষতি কি! এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই একদিন উঠে বসলাম সুইজারল্যান্ডের বাসে। মাঝরাতে বাসে উঠে পরদিন দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জারমেট-দ্য ল্যান্ড অফ গ্লেসিয়ার। উদ্দেশ্য ম্যাটারহর্ন বেইজ ক্যাম্প ট্রেক। কারিগরি উন্নতি আর শেরপা জাতির কল্যানে হাজার তিনেক ইউরো হাতে গুজে দিলে হয়ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টেনে হিঁচড়ে হলেও আমাকে চূড়া পর্যন্ত নিয়ে যাবে। কিন্তু তাতে আমার ইচ্ছে, শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই নেই। উল্টো বিশাল কোন পর্বত আরোহনে আমার ভয় লাগে; উচ্চতা ভীতির জন্য নয়। বরং আধ্যাত্মিক বা পবিত্র কিছু পায়ে মাড়িয়ে ফেললে যেমন একটা ভীতি সৃষ্টি হয় তেমন। হয়ত হতে পারে এ আমার শারীরিক অক্ষমতাকে কোন এক অযাচিত যুক্তি দিয়ে দমিত রাখার প্রচেষ্টা। সে যাই হোক, আমার উদ্দেশ্য শুধু যতটা কাছ থেকে পারা যায় অবলোকন করা।

জারমেট মূলত সুইশ-জার্মান ভাষাভাষীর লোকজন নিয়ে গড়ে ওঠা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৯০ মিটার উঁচু একটি ছোট উপত্যকা। অলস বিকেল। ছোট এই শহরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে বেড়িয়ে পড়লাম শহর প্রদক্ষিণে। যারা দার্জিলিং দেখেছে জারমেট এসে তাদের প্রথমেই দার্জিলিংয়ের কথা মনে পড়বে। গোটা দার্জিলিংকে যদি একটা থিয়েটার হিসেবে চিন্তা করি তবে তার মঞ্চ হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর পুরো দার্জিলিং শহরটা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে রাখা গ্যালারী। এখানেও তাই। পুরো জারমেট শহরের মধ্য মনি হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাটারহর্ন। শহরের যেখান থেকেই তাকাই না কেন ম্যাটারহর্ন যেন চোখের আড়াল হয় না। তাছাড়া দার্জিলিং ম্যাল রোডে যেমন মোটর গাড়ি দেখা নিষিদ্ধ, এখানেও পুরো শহরে তাই।

শরতের লম্বা দিন শেষ হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি। সময়টাকে কাজে লাগাতে কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মনে হলো অনেকদিনের ট্রেকিং না করা মরচেধরা পা দুটোকে একটু ঘসে মেঝে নিলে মন্দ হয় না। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ট্রেক। গাদা গাদা মানুষ হাতে ট্রেকিং পোল আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে বিভিন্ন ট্রেকিং পথ ধরে। তাদেরই অনুসরণ করতে করতে নিজেকে একটা সময় খুঁজে পেলাম ঘন অরণ্যানীর মাঝে। আনমনেই অনেকটা পথ উঠে এসেছি। এ পথ আমাদের হিমালয়ের মত অতটা বন্ধুর নয়। পথের দিক নির্দেশনা সুস্পষ্ট। ট্রেকিং পথের পাশ দিয়ে সাইক্লিংয়ের জন্যও আলাদা পথ রয়েছে। আমি জার্মানীতে যেখানে থাকি সেখানকার সামান্য উঁচু নিচু টিলার মত রাস্তার সাইকেল নিয়ে কি যে দুর্ভোগ বাঁধে! সে তুলনায় এই খাড়া পাথুরে পথে সাইক্লিস্টরা কেমন করে উঠে যায় ভাবতেই হাঁটু কাঁপে। এমনই পথ ধরে ঘন্টা দুয়েক হাটার পরে একটা লেকের কাছে এসে পৌঁছালাম। এখানে হরিদ্রাভ বন শেষ হয়ে গিয়ছে। কঠিন পাথরের পাশ দিয়ে খাড়া পথ উঠে গেছে আরও উপরে। রাস্তা আর আগের মত মসৃণ নেই। সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। চারপাশের পর্বতের ছায়া পড়ে ভ্যালীতে নেমে আসছে অন্ধকার। সাথে শীতল বাতাস। ম্যাটারহর্ন দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় মনে হচ্ছে চুড়ো থেকে আগুন ছিটকে বেরোচ্ছে। সেই আভায় চোখ রেখে ফিরতি পথ ধরলাম। ফিরে এসে হোটেলের বারান্দায় বসে ম্যাটারহর্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠিক কটার সময় ঘুমাতে গেলাম তা আর ঠাহর নেই।

পরদিন যখন ঘুম ভাঙে তখন সকালের রোদ ম্যাটারহর্নের চুড়ার লেগে প্রতিফলিত হচ্ছে সমস্ত উপত্যকাজুড়ে। রাতে জানালার পর্দা টেনে ঘুমাতে মনে ছিলো না। ফলে সেই রোদ চোখে লেগেই ভাঙলো ঘুমটা। ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে চোখ খুলেই পর্বতের উজ্জলতা দেখার মত আনন্দ বোধহয় অন্যকিছুতে নেই। আজকের পথ পরিক্রমা শুরু হবে সোয়ার্সসী (schwarzsee) থেকে। জার্মান সোয়ার্সসি মানে কৃষ্ণ সরোবর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ২,২৫২ মিটার। আর ম্যাটারহর্ন কেইজ ক্যাম্পের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২৬০ মিটার। অর্থাৎ আজ সমস্ত দিনে চড়াই পেরোতে হবে হাজার মিটার। সোয়ার্সসী থেকে যাত্রা শুরু হলো। ওক, বীচ আর পাইনের সারি এখানে শেষ হয়ে গিয়েছে। সামনে বিস্তীর্ণ, রুক্ষ পাথুরে জমি। সরোবরের টলটলে পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে ম্যাটারহর্ন। মৃদু বাতাসে কাঁপছে তার প্রতিবিম্ব। সে কাঁপন শিহরন বইয়ে দেয় হৃদপিণ্ডে, শিরদাঁড়ায়। ম্যাটারহর্নের বেইজক্যাম্প, যেটি হর্নিলহাট নামে পরিচিত, একটি ছোট বিন্দুর মত সেটি দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সামনের পথের পাথ রেখা স্পষ্ট। একটাই মাত্র পথ পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা উঠে গেছে উপরে। কয়েক প্যাচ উপরে উঠে, ডানে ঘুরে পথটা অদৃশ্য হয়ে গেছে পাহাড়ের পেছনে। তার পেছনের রাস্তা কেমন তা বোঝার কোন উপায়ান্তর নেই। অনেকটা সামনে গিয়ে অন্য একটা পাহাড়ের গিরিশিরা খাড়া উঠে গেছে বেইজ ক্যাম্প পর্যন্ত। সেখানে পথের কোন হদিস চোখে পড়ছে না। মাঝের শূণ্যস্থানে কি আছে পাহাড়ের এপাশে বসে তাও বোঝার কোন উপায় নেই। হয়ত কোন ভ্যালী, কিংবা লম্বা সমতল রাস্তা, কিংবা অনন্ত শূণ্যতা।

ট্রেকিং পোলের ফিতে দুটোয় হাত পুরে দিয়ে চলতে শুরু করলাম। আমি একা নই। কম করে হলেও বিভিন্ন বয়সের জনা পঞ্চাশেক ট্রেকারকে দেখা যাচ্ছে। তাদের পিছু পিছু আমিও চলতে লাগলাম। সামান্য ঘাস জন্মানো তৃণভূমি। হিমায়লের গাড়োয়াল অঞ্চলে যাকে বলে বুগিয়াল। তারই কিনারা দিয়ে পায়ে চলার পাথুরে পথ। যায়গায় যায়গায় নরম মাটি সরে পাথর বেড়িয়ে আছে এবড়ো-খেবড়োভাবে। সে পথ ধরেই আধঘন্টার মধ্যে উঠে আসলাম সে পর্যন্ত যেখান থেকে পথটা ডানে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো। মোড় ঘুরতেই চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল এক নতুন দিগন্ত। পাহাড়ের এপাশ ধরে পথটা উঠে গেছে আরও খানিকটা উপরে। তারপরেই বুগিয়ালের সবুজ ঘাস মিলিয়ে গিয়েছে কঠিন শিলায়। সামনে সবুজের আর কোন চিহ্ন মাত্র নেই। শুধুই ধূসর রুক্ষতা।

সামনে একটা কেবল কার স্টেশন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সচল নয়। হয়ত শীতকাল স্কি করতে যারা আসে তাদের জন্য খুলে দেয়া হয়। বাকি চরারচরজুড়ে কেবলই তুষারাবৃত শৃঙ্গ। এমন নৈসর্গিকতার মাঝে স্টেশনটা বেশ বেখাপ্পা লাগে। স্টেশনের পাশেই খানিকটা খোলা যায়গা। অনেকটা ভিউ পয়েন্টের মত। এতক্ষন ম্যাটারহর্ন চোখের আড়ালে ছিলো। এই যায়গা থেকে পর্বতের গোড়া পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে নিচে ম্যাটারহর্ন হিমবাহের দিকে। হিমবাহ গলে বয়ে চলা পানির স্রোত দেখা যাচ্ছে। আর একটা পথ উঠে গেছে সামনের খাড়া পাহাড়ে। এই পথটাও অনেকটা উঠে, ডানে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এমন করে কয়টা পাহাড় পার করতে হবে কে জানে। অফিশিয়াল তথ্য মতে সোয়ার্সসী থেকে বেইজ ক্যাম্প পর্যন্ত আড়াই ঘন্টার পথ। ইতিমধ্যে একঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। সামনের পথ দেখে মনে হচ্ছে চার ঘন্টায়ও বেইজ ক্যাম্প পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সে যত সময় লাগে লাগুক। আমার কোন তাড়া নেই।

একটা বোল্ডারের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ব্যাগ থেকে বের করে পানি খাচ্ছিলাম, তখনই চোখে পড়লো দম্পতিকে। স্বামী স্ত্রীর সাথে বছর ছয়েকের একটি বাচ্চা মেয়ে। তারাও যাচ্ছে বেইজ ক্যাম্পের দিকে। বাচ্চা মেয়েটির কোমড়ে একটি হারনেস বেঁধে দড়ির একপ্রান্ত ধরে আছে বাবা। সামনে হাঁটছে মা। মেয়েটির মুখে ক্লান্তি বা অবসাদের কোন লেশমাত্র নেই। দেখে মনে হচ্ছে ভারী মজার কোন খেলা খেলছে। কিন্তু আমি এরই মাঝে প্রচন্ড রকমে হাঁপাচ্ছি। এমন অসাধারণ দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো এদের অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তার কাছে আমরা নেহাতই শিশু। এখানে সবসময়েই দেখেছি বাচ্চারা খেলতে গিয়ে পড়ে গেলেও কাছে থাকা বাবা-মা কখনও ধরে উঠায় না। বরং দূরে বসে দেখে আর হাসে। বাচ্চা নিজেই উঠে দাঁড়ায়। আমিও উঠে দাড়ালাম। আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

এবারের পথটা আগের থেকে অনেকটা কঠিন ও উঁচু-নিচু। নির্দিষ্টভাবে তেমন কোন পথের রেখা নেই। সারি সারি পাথরের মাঝ দিয়ে পথ করে নিতে হয়। এইতো জগৎসংসারের নিয়ম। পথিককেই পথ তৈরী করে নিতে হয়। মাঝে মাঝে কিছু ক্লীফের মত খাড়া পাথুরে দেয়াল। ক্লাইম্বিং না করে পার হওয়ার উপায় নেই। সেসব যায়গায় পাথরের সাথে স্থায়ীভাবে সিড়ির মত করে লোহার জালি দেয়া আছে। যদিও বেশ শক্তপোক্তই, তবুও তার উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নিচে তাকালে অ্যাড্রেনালিন রাশ হয়। নিচে হাজার ফুট গভীর খাদ দেখে অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসে। কিছু যায়গায় হিমবাহ গলা পানিতে পাথর বেশ পিচ্ছিল হয়ে আছে। সাবধানে নিচে তাকিয়ে হাটতে হয়। পাহাড়ে পায়ে গুরুতর আঘাত পেলে তার ফলাফল যে কি জঘন্য হতে পারে তা একবার হাতেনাতে টের পেয়েছি। নামার সময় পা মচকে কলাগাছের মত ফুলে যাওয়া পা নিয়ে রীতিমত হামাগুড়ি দিয়ে নিচে নামতে হয়েছিলো সেইবার।

আমার কোন তাড়া নেই। ধীরে ধীরে হাটছি, সবগুলো ইন্দ্রিয় দিয়ে চারপাশের মুগ্ধতা যতখানি সম্ভব শুয়ে নিয়ে। আরও একটা চড়াই পেরিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে দেখি সামনে কয়েশত মিটার সমতল রাস্তা। তারই সামনের খাড়া দেয়াল সোজা উঠে গেছে বেইজ ক্যাম্প পর্যন্ত। এবারে মাঝে আর কোন ফাঁকা যায়গা নেই। কিন্তু এই খাড়া দেয়াল ধরে ক্লাইম্বিং না করে উপর পর্যন্ত মানুষ উঠছে কিভাবে তা এতদূর থেকে বোঝার উপায় নেই। যদিও দেয়ালের গায়ে পিপিলিকার মত মানুষের সারি চোখে পড়ছে। এভারেস্টে হিলারি স্টেপে যেমন হিউম্যান ট্রাফিক দেখেছি দূর থেকে দেখে তেমনটাই মনে হয়।

সামনে দিক নির্দেশক একটা বোর্ডে লেখা হর্নিলহাট-১ঘন্টা। কয়টা বাজে দেখার জন্য পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনে তাকাই। সাড়ে এগারোটা। মানে অফিশিয়াল দেড় ঘন্টার পথ আসতে আমি তিন ঘন্টা লাগিয়ে ফেলেছি। গত এক বছর লকডাউন, হোম অফিস, অনলাইন ক্লাসের আলসেমিতে শরীরের যে কি জঘন্য অবস্থা করে ফেলেছি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই প্রথম খটকাটা লাগলো। স্ক্রিনটা কেমনজানি কিছুটা গোলাপি বা পীতবর্ণ মনে হচ্ছে। ফোনের স্ক্রিন খারাপ হলো নাকি চোখেই কোন সমস্যা? শুনেছিলাম অতি উচ্চতায় সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি চোখের ক্ষতি করতে পারে, এমনকি অন্ধও হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু সেসব তো আরও উচ্চতায় হয়, ডেথজোনের কাছাকাছি কিংবা চারপাশ তুষারে ঢাকা থাকলে। সামনে তাকাতেই বিষয়টা স্পষ্ট হলো। ফোন বা চোখ কোনটাই খারাপ হয়নি। চারপাশের তুষারাবৃত অঞ্চল শুভ্র সাদা নয়, বরং গোলাপি। সেই গোলাপি তুষারে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে পড়ায়ই সবকিছু গোলাপি লাগছে।

কিন্তু এমনটা কেন হয়? আগে কখনো পোলাপি তুষার দেখিনি। তুষারের উপর মূত্র পড়লে সেটা হলুদ হয়ে যায় দেখেছি। কিন্তু গোলাপি কেন হয়। এরমধ্যে কি খনিজ থাকে যা থেকে “পিংক সল্ট” তৈরী হয়? এত চিন্তা কেন। এখানেও ফোনে ইন্টারনেট পাওয়া যায়। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে রেখে একটা পাথরের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে গুগল করলাম। বিষয়টা পুরোপুরি নতুন আমার কাছে। এমন গোলাপি তুষারকে বলে " ওয়াটারমেলন স্নো", “রাসবেরী স্নো” বা “ব্লাড স্নো”। Chlamydomonas nivalis নামক এক ধরনের এককোষী জলজ শৈবালের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। ক্লোরোফিলের পাশাপাশি এদের দেহে একধরনের পিঙ্গল ক্যারোটিন থাকে যার কারণে এমন পোলাপি বা লাল দেখা যায়। অ্যাল্পাইন ও মেরু অঞ্চলে দশ থেকে বারো হাজার ফুট উচ্চতায় এদের দেখা যায়। “ওয়ারমেলন স্নো” নিয়ে গবেষনা অনেক হয়েছে। এদিকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে ম্যাটারহর্নেরর সামিট পিরামিডের কাছে মাকড়সার জালের মত গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ জমতে শুরু করেছে। এবার উঠে পড়া উচিত। নয়ত বেইজ ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছাতে পুরো পর্বতই গতকালের মত মেঘে ছেয়ে যাবে।

সমতল পথটুকু নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। যেখানে শেষ হয়েছে তারই পাশে কোমড়ে হারনেস বাঁধা বাচ্চাটিকে আবার চোখে পড়লো। খাদের পাশে একটা খোলা যায়গায় বসে বাপ মেয়ে মিলে রুটিতে জেলী লাগাচ্ছে। হারনেসের অন্য প্রান্ত মায়ের হাতে। তাদের পাশ কাটিয়ে উঠে পড়লাম আকাশের সাথে লটকে থাকা পথে। এখানে পথ প্রচন্ড সরু ও খাড়া। প্রসস্ততা এক-দেড় ফুট হবে। ঢাল ৫০-৬০ ডিগ্রীর মত। কিছু যায়গায় পাথরের সাথে ফিক্সড রোপ বাঁধা। পাশাপাশি দুইজন হাঁটা যায় না। একজনকে পাশ কাটাতে হলে অন্যজনকে পাশে পাথরের উপর উঠে যায়গা দিতে হয়। দুটো বাঁক ঘুরতেই মনে হলো শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। উচ্চতা তিনহাজার মিটার পার হয়ে গেছে। বাতাসও হয়ত কিছুটা হালকা হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া অনেকদিন ধরে উচ্চতার সাথে শরীর অ্যাক্লেমেটাইজড না থাকায় বুক ভর্তি দম নিয়েও হাঁপাচ্ছি। বিভিন্ন অভিযানের বইগুলোতে পড়ি সামিট পুশের দিন অভিযাত্রীরা এক পা হাটে একবার দম নেয়। এই সামান্য উচ্চতায়ই আমার এ অবস্থা। ডেথজোনে তাঁদের যে কি প্রচন্ড রকমের মানসিক ও শারীরিক দক্ষতার প্রয়োজন হয় এমন অবস্থায় না আসলে সমতলে বসে তা কল্পনাও করতে পারবেনা কেউ কোনদিন।

উপরে তাকালে তীব্র নীল আকাশ আর পাথরের চাঁই এবং বামে গভীর খাদের নিচে গোলাপি হিমবাহ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। কিছু কিছু যায়গায় ক্লাইম্বিং করা ছাড়া উপায় নেই। সেসব যায়গায় স্থায়ীভাবে লোহার মই সেঁটে দেয়া হয়েছে। চলার গতি আরও শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। যতবারই হাই অল্টিচুটে ট্রেকিং করেছি প্রতিবারই মাথার ভেতরে একটি কথাই ঘুরপাক খেয়েছে- “কেন করছি এসব? কি হচ্ছে শরীরকে সহ্য সীমার চুড়ান্তর নিয়ে গিয়ে? এর জন্য তো কেউ আমাকে টাকা-পয়সা দিবে না। না হবে নাম খ্যাতি।” আমি তো কিছুইনা। দুনিয়াজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন পর্বতারোহীদেরও একই প্রশ্ন শুনতে হয় জীবনভর। তাদের মধ্যে আমেরিকান পর্বতারোহী এড ভিয়েশ্চার্সের উত্তরটা আমার সবথেকে মনঃ পূত হয়- “If you have to ask, you will never know.” বাস্তবিকভাবেই এর উত্তর কাউকে মুখে বলে বোঝানে যাবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না সে একই অবস্থায় এসে অনুধাবন করতে পারবে।

এসবই ভাবতে ভাবতে আরও কতগুলো চড়াই পেরিয়েছি তার হিসেব নেই। তবে পা আর চলছে না। এখন সামনে বেইজ ক্যাম্পের ঘরটি দেখা যাচ্ছে। হয়ত আরও এক-দেড়শ ফুট। হাটছি বলে এখন আর মনে হচ্ছে না, বরং শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে উপরে তুলছি এক-পা, দু-পা করে। আরও মিনিট বিশেকের কসরত শেষে যখন উপরে উঠে এলাম তখন বেইজ ক্যাম্পের চেহারা দেখে বিস্মিত হলাম বৈ কি। যায়গাটা আমাদের হিমালয়ের পর্বতগুলোর বেইজ ক্যাম্পের মত না। কংক্রিটের দোতলা ইমারত। নিচতলায় সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ আর উপরের তলায় ম্যাটারহর্ন অভিযাত্রীদের জন্য হোটেল। সামনের খোলা যায়গায় পর্বতের গায়ে মাচার মত করে বানানো চেয়ার টেবিল বসানো ওপেন স্পেস। সেখানে প্রায় শ’খানেক মানুষের খাবারের তোরজোড় চলছে। দেখে ঠিক বেইজ ক্যাম্প মনে হয় না। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলাম বলতে হয়। কিন্তু রেস্তোরাঁটিকে পাশ কাটিয়ে পেছন দিকটায় গেলে সব ধারণা ভেঙে যায়। সামনে আদিম সর্পিণীর মত পাথুরে পথ খাড়া ইঠে গেছে হাজার মিটার। এতগুলো মানুষের পাদচারণের চিহ্ন কোথাও নেই। আরোহনের অনুমতিপত্র ছাড়া এদিকে আগানোর উপায় নেই।

রেস্তোরাঁ থেকে রোস্টি নামক কোন একটা খাবার নিয়ে ঢালের দিকটায় টেবিলে একটক ফাঁকা যায়গা দেখে বসে পড়লাম। পেট ক্ষুধার্ত থাকলেও খাওয়ার রুচি নেই কিছুই। সামনে ম্যাটারহর্ন ছাড়াও ফ্রুগেন, থিওডালহর্ন, ব্রাইটহর্ন, লিক্সাম, পুন্টা গিনিফেট্টি সহ আরও অচেনা অসংখ্য চার হাজার মিটারের পর্বত। মনে হয় কোন নাট্যমঞ্চে উপস্থিত হয়েছি আর প্রত্যেকটা পর্বত নিজ নিজ চরিত্রে ভূমিকা পালন পালন করে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে চুড়ার কাছাকাছি মেঘেদের আনাগোনা দৃশ্যপট পালটে দিচ্ছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে যায়, চোখের পাতা আদ্র হয়, বুকের ভেতরে কাঁপন ধরে। এমনিভাবেই ঘন্টাখানেক পেরিয়ে যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সবগুলো চুড়োতেই মেঘ জমতে শুরু করেছে। এবার ফিরতে হয়। আড়াই ঘন্টার চড়াই সাড়ে চার ঘন্টার উঠেছি। উৎরাইয়ে কত সময় লাগবে কে জানে। পর্বতে ওঠাই সম্পূর্ণ অভিযাত্রা নয়, এ তো কেবল অর্ধেক পথ। বিকেলের মধ্যে উপত্যকায় পৌঁছাতে হবে। হোটেলে রিজার্ভেশন নেই। আজই চলে যেতে হবে। আরও একবার পেছন ফিরে পৃথিবীর সবচেয়ে চিত্রায়িত পর্বতের পানে তাকিয়ে বললাম- আবার হয়ত দেখা হবে। নামতে শুরু করলাম। কালকের গন্তব্য আইগারের উত্তর গাত্র; ম্যাটারহর্ন যদি আল্পসের সবচেয়ে সুন্দর পর্বত হয়, দ্য নর্থ ফেস অফ আইগার তবে সর্বাপেক্ষা ইতিহাস সম্পন্ন।