ঘুম ভেঙে স্বপ্ন মনে না থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দুঃস্বপ্নগুলো মাথার মধ্যে দপদপ করতে থাকেনা। যদিও ঘামে ভেজা শরীর ক্রমশই মনে করিয়ে দেয় তা মোটেই সুখকর ছিলো না। এরপর সবকিছু ধীরেধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। উইন্ডো ব্লাইন্ডটা বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে যাওয়ায় বাইরের প্রবারণা পূর্ণিমার চাঁদের রুপোলী আলো ভরিয়ে ফেলেছে পুরো ঘরটাকে। ক্লান্ত জানালার কার্ণিশে ঝুলে আছে উদাসীন বাতাস। ঝকঝকে ঘরটা যেন গার্হস্হ্য শুন্যতার এক পোর্টফলিও। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার নিমিত্ত ভর্তি তৈজসে বন্দী কিছু নৈমত্তিক হিস্টরিয়া, দেয়াল জুড়ে লেপটে থাকা কিছু বেঢপ বিষণ্ণতা।
বেয়ারা ঘুমটা বোধহয় এখন আর আসবে না। জানালায় গিয়ে দাড়াই। মাথার মধ্যে শুরু হয় ঘুণপোকার শব্দ। এমন চাঁদের আলোতেও জ্বলে থাকা ল্যাম্পপোস্টাকে আমার বড় অসহায় মনে হয়। যেন আমারই মত সকলের দৃষ্টির অগোচরে থাকা কোন এক অনস্তিত্ব। মনে হয় হঠাতই মুছে গিয়ে ফিরে আসা কোন এক মানবালোক। অবশ্য সব মানুষই এক ধরনের জ্যোতি, শুধু আমিই অদৃশ্য, বিস্মরণের আলো- ক্ষয়াটে কিংবা নিস্প্রভ। আমি যেন ছায়ার মত বড়ই বিস্মৃতিপ্রবণ; কারো কারো চোখে দৃশ্যমান কিন্তু-অপরিচিত।
ইন্সটাগ্রাম খুলে স্ক্রল করতে শুরু করি। চোখে পরে ম্যাথু প্যারি মারা গিয়েছে। মাথা ভারী হয়ে আসে। মস্তিষ্ক দৃষ্টিকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখে রাখা এপিসোডটা দেখতে শুরু করি। ম্যাথুর সার্কাজম বিষণ্ণ লাগতে শুরু করে। মানুষ যখন মরে যায়, কেন তার সমস্ত অর্জন, তথ্য মুছে যায় না? মৃত মানুষের অস্তিস্বশীল হয়ে থাকাটা আমার কাছে খুব বিস্ময়ের লাগে। মনে হয় মৃত অভিনেতা তার অভিনীত প্রতিটি দৃশ্য থেকে ক্রমেই মুছে যেতে থাকবে। মৃত চিত্রকরের প্রতিটি তুলির আঁচড়, প্রতি ফোঁটা রং মুহুর্তেই চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাবে। এভাবেই প্রতিটি মানুষ রিউইন্ড করে অনস্তিত্বশীল হয়ে যাবে। কিন্তু তার কিছুই হয় না। ম্যাথুর অভিনয়ে আপনমনেই হেসে উঠি।
এ হাসি বড়ই অদ্ভুত। এ হাসি তোমার আমার সহস্র বিস্মৃতি নিয়ে আসে। মনে পড়ে শতবর্ষ পূর্বে এমন হিম রাতে নিঃসাড় অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরে যখন ম্যাথুর অভিনয় দেখতাম তখন এমনই হাসির অড়ালে ঢাকা পড়ে যেত তোমার পোরসেলিন মুখের নির্লিপ্ত অভিনয়। মনে পড়ে বাস্তবসত্য আর তত্ত্বসত্যের মাঝপথে অস্পষ্ট রেখায় দাড়িয়ে থেকে তোমাকে খোঁজা আমাদের পারস্পারিক শুণ্যতায়।
আমারও মাঝে মাঝে সার্কাস্টিক হতে ইচ্ছে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রোদে পোড়া বাতাসে নীলের অসীমে হারিয়ে যেতে। মৃত গোলাপের শহর ছেড়ে ডুব যেতে ইচ্ছে হয় কালো বিড়ালের নীল চোখের ভিতরে। অক্টোবরের শেষে ম্যাপল আর ওকের শেষ পাতাটা ঝরে গেলে ক্লান্ত শিশিরের নম্রতা ছুঁয়ে যে বিড়ালটা আলতো পায়ে ধীরলয়ে হেঁটে যাবে অন্ধকার করিডোরে; তিমিরের নিওলিথ স্তব্ধতায় অস্তগামী ফুলেদের সাথে চলে যাব চোখের বিশ্রামে। রেললাইন পেরিয়ে নেমে আসবে একটা ফিঙেরঙা সন্ধ্যা। আমি টের পাই মগজের গারদে ডুকরে ওঠে এক নাক্ষত্রিক বোধ।
অথচ রোদে পুড়ে যাওয়া চেতনার জগতে আজ নিয়ত সংকোচন। করোটির ভেতরে থইথই করে পঁচে যাওয়া জ্যোৎস্নার হেমলক। অথচ রজনীগন্ধা রাতে আকাশের কপোল চন্দ্রাতপে রুপালি করে চেয়েছিলাম মেঘগুলো নির্বাসিত হোক। আজ আমার শিরার ভিতর রক্ত জমাটবাধা-শীতল বরফের মতো চুপচাপ। জলের স্বেচ্ছাচারী কল্লোলের সন্ত্রাসে বেঁচে নেই শামুকগুলো। বেবিলনের হৃদয়ে গাঁথা শঙ্খমালা আজ ঘাসেদের চাদর পেরিয়ে নির্জন আকাশের সমসত্ত্ব অন্ধকারে নির্বাসিত। মৃত নগরীতে আজ মায়াহীন সোডিয়ামের আস্ফালন। অশ্বথের তলায় পড়ে আছে নৃশংস ভাবে হত্যাকৃত কবিতা। মৃত গোলাপের শহরে দৃশ্যের পট জুড়ে আছে চির বৈশ্বিক আঁধার।
আজও ‘কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ ‘পঞ্চমীর চাঁদ’ ডুবে গেলে ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খেতে’ ব্যস্ত হয়, জ্যোৎস্নার আড়ালের তিমিরে নিঃসঙ্গ চিঠির বাক্সে নিঃসীম আকাশের অসীম শুন্যতার অনুরণন সোনালি ঘুঙুরের মতো বাজে। হলুদ পাতাদের ক্রন্দনে বুক পাজরে সময়ের স্রোতে অজশ্র দীর্ঘশ্বাষ জমে পোয়াতি রাত্রি তুষার ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। আর আমি অনেক অনেক দূরে নির্জন নক্ষত্রের অব্যক্ততায় ফিনিক্সের পালকের মনমর্মর হয়ে ফিরে চাইছি নক্ষত্রের রুপালি রোদ।