এ বছরের শুরুতে যখন বাৎসরিক পরিকল্পনা করছিলাম তখন ভাবছিলাম ইউরোপের তথাকথিত “উন্নত” জীবনে আসার এক বছর পরে নিজের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত হয়েছে? ঢাকায় মেসে আমার ব্যক্তিগত জিনিস বলতে ছিলো একটা ল্যাপটপ, একটা প্রিন্টার, একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন, হাফ ডজন শার্ট-প্যান্ট আর একগাদা বই। অন্যদিকে এখানে গত এক বছরের লকডাউনে বাসায় বন্দী সময় পার করতে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের রীতিমত সংসার সাজিয়ে বসেছি। শখ বলি আর প্রয়োজন বলি, কারণে অকারণে এত এত গ্যাজেট কিনেছি যে নিজেরই অবাক লাগছে। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে “উন্নত” মনে হতে পারে। আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু যখন দুইটা জীবনের মধ্যে তুলনা করতে একটা ছোট্ট প্রশ্ন ব্যবহার করলাম- “কি হতো যদি আমি এটা না কিনতাম?”, তখন নিজের সম্পর্কে ধারণাটা পুরোপুরি বদলে গেল।

আমার ১৩ বর্গমিটারের ছোট স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকা সব জিনিসের তালিকা করে এই একটি প্রশ্নই জিজ্ঞেস করেছি। ফলাফল- আমার অ্যাপার্টমেন্ট এমন অনেক জিনিস দিয়েই ভর্তি যেগুলো না থাকলেও তেমন কোন ক্ষতি ছিলো না। যেমন একটা রাইস কুকার আর একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন আছে। আমি চাইলেই ওভেনেই ভাত রান্না করতে পারি (আগের ডর্মে থাকতে করতামও তাই)। এরপরে ই-বে তে কম দামে পাওয়ায় রাইস কুকারটি নিয়েছি যার বস্তুত কোন প্রয়োজনই ছিলো না। আবার ধরি কিছুদিন আগে অবসর সময় কাটানোর জন্য প্লেস্টেশন কিনলাম। আগে বিকেলের যে অবসর সময়টা বই পড়ে কিংবা হাটাহাটি করে কাটতো সে সময়টা এখন কাটে ভিডিও গেম খেলে, যেটা আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনে কোন ভ্যালুই অ্যাড করছে না। এরপরই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত আর কোন কিছুই গ্রহন করব না এবং সেই সাথে প্রবেশ করলাম এক নতুন জীবনদর্শনে- ন্যূনতমতা বা মিনিমালিজম।

কিন্তু মিনিমালিজম কী? হালের হুজুগ এই মিনিমালিজম আসলো কোথা থেকে? কি হবে মিনিমালিজম চর্চা করে?

নব্য মিনিমালিজমের গোড়াপত্তন ঘটে মূলত নিউইয়র্কের গত শতাব্দীর ষাটের দশকে একদল শিল্পীদের বিদ্রোহের মাঝ দিয়ে। আধুনিক ক্যামেরা ততদিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই দিনে দিনে শিল্পীদের আঁকা পোট্রের্ট ছবির সাথে সাথে অন্যান্য ছবির চাহিদাও কমতে শুরু করেছে। তখন অধিকাংশ শিল্পী মনোনিবেশ করলেন অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের দিকে। অর্থাৎ ছবির সুস্পষ্টতা থেকে বিচ্যুত হয়ে মানুষকে তাদের ছবির প্রতি আকৃষ্ট করতে তারা ছবির ভেতরে নানান উপমা দিয়ে বিমূর্ত এক বা একাধিক ভাবনাকে প্রকাশ করতে লাগলেন। অন্য একদল শিল্পী শিল্পের এই ধারাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। তাদের মতে চিত্রকলার নামে যা হচ্ছে তা পুরোটাই প্রতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ও শিক্ষার জন্য।

প্যারিসে তখন ইপ্রেশিনজমের জয়জয়কার। এদুয়ার মানে, ক্লদ মনে, এডগার দেগা, জাঁ রেনোয়া, পল সেজানএর মত শিল্পীরা যখন নিয়ম ভেঙে নতুন কিছু করার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, পুরো ইউরোপের মত তাদের কাজের ধরন অনুপ্রানিত করেছিলো নিউইয়র্কের চিত্রশিল্পীদেরও। তারাও অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের মত রূপক ও প্রতীকি ছবির স্থূল ধারনা থেকে বের হয়ে তুলনামূলকভাবে সূক্ষ্ম ও নিখুঁত কাজের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে লাগলেন। যতটা সম্ভব কম কৌশল ও উপাদান ব্যবহার করে চিত্রকলায় তাদের কাজ প্রশংসিত হতে লাগলো। তারা এটাকে বলতে লাগলেন মিনিমালিজম চর্চা। সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপে আলোড়ল ফেলে দিলো তাদের এই মিনিমালিজম চর্চা।

মিনিমালিজ-এর বাংলা পরিভাষা ‘ন্যূনতমতা’, যেটা শুনে প্রথমেই মনে হতে পারে মিনিমালিজম মানে ন্যূনতম ভোগ। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পণ্যের বেশি থাকা যাবে না, আয়েসী জীবন কাটানো যাবেনা, ছোট একটা আসবাবপত্রশূণ্য বাসায় জীবন যাপন করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা মোটেও তেমনটি নয়।

মিনিমালিজমকে বলা যায় একটা জীবনদর্শন বা জীবনচর্যা। এটা একটা জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। সিদ্ধার্থের একটি মুর্তি কিনে বাসায় এনে সাজিয়ে রাখলেই যেমন নির্বান লাভ করা যায় না, তেমনি একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজের অধিকৃত সব সম্পত্তি বিলি বন্টন করে দিয়ে মিনিমালিস্ট হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

নিজেকে মিনিমালিস্ট তখনই বলা যায়, যখন আমি বুঝতে পারবো আমার অর্জিত পণ্যের মধ্যে কোনগুলোকে আমি অগ্রাধিকার দেই। কোনগুলো আমার আসলেই দরকার, কোনগুলো আমি দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত ব্যবহার করি। হতে পারে আমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য আমার কাছে আছে। তখন সেটা বিক্রি বা বিলি করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি যদি সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে মিনিমালিস্ট হওয়ার চেষ্টা করি তবে একটা সময় গিয়ে দেখবো আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি এবং বেচে দেয়া পন্যগুলোরই নতুন ভার্সন কিনে বসে আছি।

মিনিমালিজমের বাঁধাধরা কোন নিয়ম নেই যে মিনিমালিস্ট হতে হলে আপনাকে সেই নিয়ম গুলো অনুসরণ করতেই হবে। মিনিমালিজম মানে সাদাসিধে জীবনযাপন। ‘সাদাসিধে’র মানে জনে জনে আলাদা। এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের জীবনযাপন নিয়ে স্পষ্ট দর্শন থাকতে হবে ঠিক কোন বিষয়গুলোকে আমি আমার জীবনে সাদাসিধে বলব।

একবার ভাবুন আপনার ঠিক কতগুলো জিনিস আছে। তার মধ্যে কোন কোন জিনিসগুলো প্রত্যাহিক জীবনে ব্যবহার করেন। এসব ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে কতগুলো আপনি নিজের প্রয়োজনে কিনেছেন আর কতগুলো লোক দেখাতে বা পরিবার ও বন্ধুদের কাছে প্রাধান্য পেতে কিনেছেন। এই যে বাড়তি জিনিসগুলো এগুলোর কি আদৌ আমাদের জীবনে কোন আবশ্যকতা রয়েছে? এগুলো থেকে আমরা কি কোনভাবে উপকৃত হচ্ছি? বরং অতিরিক্ত জিনিসগুলো আমাদের ক্ষতিই করছে। কিভাবে?

আপনি যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসগুলো জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিবেন তখনই এই ‘কীভাবে’র উত্তরটা আপনার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আপনি তখনই নিজেকে সুখী ভাবতে শুরু করবেন যখন দেখবেন মানুষ আপনার কি আছে সেটা দেখে নয়, বরং আপনাকে দেখে আপনাকে পছন্দ করবে। এটা আপনার আত্মপ্রত্যয় বাড়াতেও সহায়তা করবে।

আমাদের এই নশ্বর জীবনে বেঁধে দেয়া সময় নির্দিষ্ট। আমরা চাইলেই এই বাঁধা-ধরা সীমাবদ্ধ সময়ে আমাদের অসীম চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারি না। তাহলে আমরা আমাদের অসীম চাহিদা থেকে কোনগুলোকে বেছে নিবো? কোনগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিবো? যেগুলো আমাদের কাছে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ বা যেগুলো নিয়ে আমরা বাস্তবিকভাবেই সুখী হতে পারি। ধরুন আপনাকে একটি জার, কিছু বড় পাথর, কিছু নুড়ি পাথর ও বালি দিয়ে বলা হলো জারটিকে পূর্ন করতে। আপনি পূর্ন করতে গিয়ে যদি আপনি প্রথমে বালি ও নুড়ি পাথর রাখেন তাহলে দেখা যাবে শেষে বড় পাথরগুলোর জন্য আর কোন যায়গা অবশিষ্ট নেই। উল্টোভাবে প্রথমে যদি বড় পাথরগুলো রাখেন এবং এরপরে ধীরের ধীরে ছোট গুলো রাখতে শুরু করেন তাহলে বড় পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নুড়ি পাথর ও বালি ঠিকই এঁটে যাবে। বাস্তব জীবনেও “বড় বস্তুটি সর্বদা আগে” যাবে। এখন আপনার কাছে কোনটা বড় সেটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত। এ কারণেই মিনিমালিজমের কোন নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। সবার প্রধান্য আলাদা। আমাদেরকে শুধু ঠিক করতে হবে কোনগুলোকে আমরা বেশী প্রাধান্য দিবো।

আমরা যখন আমাদের অপ্রয়োজনীয় স্থূল চাহিদাগুলোকে সংবরণ করে ফেলবো, তখন আমরা আমাদের সেই বিষয়গুলতে বেশি সময় ও সূক্ষ্ম মনোযোগ দিতে পারবো যেগুলো আমাদের জীবনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরুন আপনার যদি পঞ্চাশটা জামা থাকে সেখান থেকে একটা জামা পরার জন্য বাছাই করতে বেশি সময় দিতে হবে পাঁচটা জামা থেকে একটা বাছাই করার থেকে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রফেসর ছিলেন, আমাদের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ক্লাস নিতেন। একদিন ক্লাসের সময় দেখলাম তার শার্টের হাতার কাছে কিছুটা অংশ ছেঁড়া। কোথাও যেন বিভ্রতকর অবস্থায় পড়তে না হয় তাই ক্লাসের পর তাকে বললাম তার শার্টের হাতার কিছুটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। উত্তরে তিনি বললেন, তিনি জানেন তার শার্টটা ছেঁড়া আছে। কিন্তু একটা রিসার্স প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তা করতে করতে অন্য কোন শার্টটি পড়া যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। তার কাছে মনে হয়েছে ভোরবেলা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে জামা বাছাই করার থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তা করাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

মিনিমালিস্ট হওয়ার আর একটি বড় সুবিধা অর্থনৈতিক। আপনি যখন দৈনন্দিন জীবন থেকে অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত জিনিসগুলো বাদ দিয়ে দিবেন তখন বাস্তবিকভাবেই আপনার মাস শেষে আয়ের কিছুটা অংশ হলেও সঞ্চয়ে জমা পড়বে। হতে পারে সেটা সংকটকালীন মুহূর্তের জন্য সঞ্চয়, বৃদ্ধ বয়সের জন্য সঞ্চয়, কিংবা আসছে বছর মালদ্বীপ ভ্রমনের সঞ্চয় বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সঞ্চয়।

আমাদের ক্রয় করা প্রতিটা জিনিসের একটা “সুযোগ ব্যয়” আছে। “যদি এটা না কিনি?” এই ছোট্ট প্রশ্নটি  সেই সুযোগ ব্যয় আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে। যেমন- এই ফোনটি যদি না কিনি তাহলে কত টাকা পরের ভ্রমনের জন্য সঞ্চয় করতে পারবো? এই শার্টটা যদি না কিনি কত টাকা তাহলে সংকটকালীন সঞ্চয়ে জমা পড়বে? এই জুতাটা যদি না কিনি তাহলে এই টাকা দিয়ে আর কি করা যেতে পারে?  আমরা যখনই কেন নতুন জিনিস কিনি আমরা আমাদের স্বাধীনতা কিছুটা হলেও নষ্ট করি। এই একটা প্রশ্ন আমাদের নষ্ট করা স্বাধীনতার সাথেই পরিচয় করিয়ে দেয়।