হিমালয়! নামই যার সমস্ত গাম্ভীর্য ধারণ করে আছে, পৃথিবীর সকল উচ্চতম পর্বতগুলোই যে পর্বতমালার অন্তর্গত, সমস্ত আধ্যাত্মিক চেতনাকে সহস্র বছর ধরে কেন্দ্রীভূত করে আসছে যে গিরিশ্রেণী, নিজের রূপ-সূধায় মুগ্ধ করে, আরোহনের প্রলোভন দেখিয়ে হাজারো পর্বতারোহীর জীবন কেড়ে নিয়েছে যে পর্বতমালা, পৃথিবীর তৃতীয় মেরু নামে পরিচিত সেই হিমালয়ের কনকনে শীতল হাওয়া বরাবরই আমার আমার মেরুদন্ড দিয়ে এক শীতল স্রোত সঞ্চারণ করে দেয়। তার প্রতিটি রুক্ষ কঠিন শিলা আমার কৈশরের, আমার যৌবনের তপ্ত অতুভূতিকে তীব্র আঘাত করে আমার চেতনার উপর জমে থাকা মরচেগুলোকে ঝেড়ে ফেলে শিরকে সমুন্নত রাখতে শিখায়। আমি টের পাই তার শুভ্রতার চাদরে আমাকে জড়িয়ে রাখতে চায় জন্মান্তর ধরে।
শেষ হিমালয় থেকে এসেছি গতবছর ডিসেম্বরে, ভারতের উত্তরখান্ড রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয়ের একটি ছোট্ট পর্বত কেদারকান্থ আরোহন করে। ওটাই ছিল আমার প্রথমবার উত্তরখান্ডে যাওয়া। আর প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়া। মনে হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা যখন স্বর্গ তৈরী করছিলেন তখন কোন এক কারণে স্বর্গের ছোট একটি খন্ড বিচ্ছিন্ন হবে ধরিত্রীর বুকে ভূপতিত হয়েছিল। পরে সেই অংশটারই নাম হয়ে গেল উত্তরখান্ড। কি মনোমুগ্ধকর শোভা তার! কি অপরূপতা! তার সৌন্দর্য যেন জীবনকে নিয়ে যায় অন্য এক জীবনে, আত্মাকে করে দেয় পরিশুদ্ধ, মনকে করে স্নিগ্ধ, সিক্ত।
এরপর জানুয়ারী থেকে শুরু হলো চুড়ান্ত নাগরিক ব্যস্ততা। একেই গ্রাজুয়েশনের সর্বশেষ সেমিস্টার, তার উপর ইন্টার্নশীপ, থিসিসের কাজ, শেষে দিকের ইলেকটিভ কোর্সগুলোর যন্ত্রনা। সব মিলিয়ে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। একটুকু মুক্তির জন্য ছটফট করছিলাম। তাও প্রেরণা ছিল এতটুকুই যে এইতো, এইটুকুন শেষ হলেই আমার ছুটি।।আমি আবার ছুটে যাবো হিমালয়ে। চিত্তের ব্যকুলতাকে চরমে পৌঁছে দিয়ে অবশেষে সেমিস্টার শেষ হলো। রিপোর্ট জমা দিয়ে, ডিফেন্স শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষান্ত হলাম। এবার আবার ছুটি। একটি নিমেষশূণ্য সুন্দর বিকেল, পাহাড়ের ভ্যালীতে বসে দুই পাহাড়ের খাঁজে ডুবতে থাকা অস্তাচল একটা লাল সূর্য, শহরের পীচঢালক বিদগ্ধ বুক ছেড়ে হিমালয়ের মীতল বুকে শুয়ে থাকার যে কল্পনা বুনেছিলাম তার জন্য এবার সময় মিলবে। এবার একটা অজানা গন্তব্য মিলবে।
গতবছর থেকেই পরিকল্পনা ছিলো গ্রাজুয়েশন শেষ করে নেপালে অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকে যাবো। কারণ আমাদের মত নাগরিক মানুষের পক্ষে একসাথে এতদিনে ছুটি জোগাড় করা শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, অসম্ভবও বলা চলে। পরিকল্পনা মতই ঠিকও ছিলো সবকিছুই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাঁধ সাধলো মার্চের ভয়াবহ বিমান দূর্ঘটনা। টিভিতে দূর্ঘটনার সংবাদ দেখে আম্মু নন্দলালের ভুমিকা নিয়ে বলল, “যেখানেই যাও, বিমানে যাওয়া চলবে না।” অনেক বুঝিয়েও যখন শেষ রক্ষা হলো না তখন অগত্যা বিকল্প খুঁজতেই বাধ্য হলাম। তখন খেয়াল হলো আরে বাবা এতো খোজাখুজির তো কিছু নেই, পুরোনো প্রেম উত্তরখান্ড তো রয়েছেই। কিন্তু শুধু থাকলেই তো চলবে না, জুতসই রুট খুঁজে বের করা, অবজেক্টিভ আইডেন্টিফাই করা, ম্যাপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করা, পরিকল্পনা সাজানো এগুলোও যে নতুন করে সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে।
পুরো হিমালয়টাই তো একটা অবাধ বিচরনক্ষেত্র যার পুরোটাই অভিনত্বে, সৌন্দর্য্যে ঠাসা, যা সমস্ত জীবনেও দেখে শেষ হবে না। এতো এতো পথের মাঝে মাত্র কয়েকদিনের জন্য পছন্দমত একটা রুট খুঁজে বের করতে রীতিমত মনে সাথে যুদ্ধ করতে হয়। আবহাওয়া, ডিফিক্যাল্টি, টেকনিক্যালিটি ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক সবকিছু পাশাপাশি সাজিয়ে দেখলাম এই সময়ের জন্য রুপকুন্ডের দিকে যাওয়াই আমার জন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্ত হবে।
সিদ্ধান্ত তো নিয়ে ফেললাম। এবার পরিকল্পনার পালা। অন্তর্জাল ঘেটে, বিভিন্ন ব্লগ পড়ে, পরিচিত কয়েকজনের সাথে আলাপ করে যেখানে যা তথ্য পাচ্ছিলাম সেটাই নোট করে একটা খসড়া পরিকল্পনা দাঁড় করে নিলাম। এরই মাঝে কথা হলো সুপ্ত ও সন্ধির সাথে। ওরা আমার সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কথা বলে জানলাম ওদেরও একই সময়ে একই দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পূর্বের বেশ কিছু অভিজ্ঞতাও রয়েছে ওদের। তাই ভেবে দেখলাম এবার না হয় একাকী বাদ দিয়ে দল করেই যাওয়া যাক। নতুন কিছু অভিজ্ঞতাও হবে আর পূর্বের অনেক অভিজ্ঞতাও আদান-প্রদান করা যাবে।
আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে গত এপ্রিলেই। দেখতে দেখতে মে মাস এসে গেল। কিন্তু ভিসার জন্য এপ্লিকেশনই করতে পারছিলাম না এপ্রিলের শেষের দিকে টানা সরকারী বন্ধ থাকার কারণে। এদিকে শীঘ্রই রওনা না দিলে সময় দিয়েও পারা যাবে না। অবশেষে ৬ মে এপ্লিকেশন জমা দিয়ে যখন দেখলাম পাসপোর্ট ফেরত দিবে ১২ তারিখে তখন বিলম্ব না করে ১২ তারিখেরই যাত্রার জন্য মনস্থির করে বাসের টিকেট করে ফেললাম। অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করলাম। আগে যেহেতু কয়েকবার যাওয়া হয়েছে তাই এবারে ভিসা রিজেক্ট হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনাও নেই। ৭ দিনের অপেক্ষার মনে হতে থাকলো দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী চেকলিস্ট দেখে দেখে সবকিছু এক এক করে জোগাড় করে ব্যাগ প্যাক করতে শুরু করলাম। তালিকার বেশিরভাগ জিনিসই আসলো লিমন ভাইয়ের কাছ থেকে। যদিও তুষার ভাইও বলেছিল তার কাছে থেকে যা কিছু লাগে নিয়ে নিতে। কিন্তু তার মত পাটকাঠির কোন কিছু আমার লাগবে না আর লাগলেও তার নারায়নগঞ্জ বাসা থেকে গিয়ে নিয়ে আসার কষ্টের কথা স্মরণ করেই সে চিন্তা বাদ দিলাম। শেষ যা বাকি ছিল মঈনের কাছ থেকে নিয়ে এসে ১১ তারিখ রাতের মাঝেই ব্যাকপ্যাক টুইটুম্বুর করে ফেললাম। এরপরেও যদি কিছু দরকার পড়ে একদিন তো কলকাতায় থাকছিই, তখন ডিক্যাথলন থেকে কিনে নেয়া যাবে ভেবে রেখে দিলাম। সেই সাথে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত খোঁজ রেখে যাচ্ছিলাম সাম্প্রতিক আবহাওয়ার।
১২ ই মার্চ। একটি ব্যস্ততম দিনের শুরু। ঘুম থেকে উঠেই শেষবারের মত সবকিছু চেক করে ব্যাগ প্যাক করে ছুটলাম শ্যামলীর আইভ্যাক সেন্টারে। পাসপোর্ট ডেলীভারী দেয়ার কথা বিকেল সাগে তিনটায়। গিয়ে পৌঁছালামও মাড়ে তিনটার দিকেই। কিন্তু ততক্ষনে ইয়া লম্বা লাইন লেগে গেছে। একসময় লাইন ঠেলতে ঠেলতে মামনে গিয়ে যখন ভিসা সহ পাসপোর্ট নিয়ে বের হলাম তখন বিকেল সাড়ে চারটার মত বেজে গেছে। মনটা আকুপাকু করতে শুরু করে দিয়েছে। আহ! কতদিন পরে আবার হিমালয়ের স্নিগ্ধতায় অঙ্গ জুড়াবো, কতদিন পরে আবার যাত্রা করবো স্বপ্নালোকের পথে। ভাবতেই শিহরন বয়ে যায়। কেমন হবে এবারের অভিযান? অতীত অভিযানগুলোর সাথে কি মিল থাকবে? পার্থক্য হবে? ভাততেই ভালো লাগে। কিন্তু এখন ওসবের সময় নেই। বাস ছাড়বে রাত ১১ টায় কলাবাগান থেকে। শ্যামলী থেকে আমার বসুন্ধরা বাসা বেশ অনেকটা পথ। আবার কলাবাগানও যেতে হবে। তাই ভাবনাগুলোকে আপাতত পাশ কাটিয়ে তড়িঘটি করে ছুটলাম বাসার দিকে। এত তাড়াহুড়োয়য় যে সারাদিন কিছু খাইনি সেটাই মনে ছিলো না। বাসায় এসে গোসল করে, খেয়ে, ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে ফেলে ছুটলাম কলাবাগানে। তবুও বাস ছাড়ার প্রায় ঘন্টাখানেক আগে পৌঁছে গেলাম বাসস্ট্যান্ড।
বাসস্ট্যান্ড গিয়েই একের পর এক হতাশার সংবাদ শোনা শুরু হলো। ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলার কারণে সন্ধি শেষ পর্যন্ত যেতে পারছে না। আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে আরও দুইজন- সুদীপ্ত ও অমৃতা, দুই ভাই-বোন। সুপ্তর কলেজের বন্ধু সুদীপ্ত। কিন্তু যখন শুনলাম ওরা একদমই নতুন, হাই অল্টিচুড তো দূরে থাক দেশেই তোর ট্রেকিং এর তেমন অভিজ্ঞতা নেই তখন মনটা বিষিয়ে উঠল। সম্পূর্ণ নতুন কাউকে নিয়ে ট্রেকিংয়ে যাওয়া আমার কাছে বরাবরই অস্বস্তিকর মনে হয়। তার উপর এমন মডারেট রেটিং এর হাই অল্টিচুড ট্রেকে! কোনভাবেই মন সায় দিচ্ছিলো না। কারণ এই ধরনের মানুষের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এরা প্রচন্ড খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়। এটা করতে পারবো না, এখানে থাকবো কি করে, এটা খেতে পারবো না জাতীয় সমস্যায় ট্রেকিং এর মজাটাই পানসে হয়ে যায়। আগে জানলে হয়তো এখান থেকে কেটে পগে আগের মত একাই বেড়িয়ে পড়তাম। সুপ্ত বারবার আশ্বাস দিতে শুরু করলো যে তেমন কিছুই হবে না, ওরা মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু মন কি আর ওসব বোঝে! কিন্তু এখন নিরুপায়। অগত্যা ওদের তিনজনকে নিয়েই বাসে চেপে বসলাম। কাঁটায় কাঁটায় রাত ১১টা নাগাদ বাস চলতে শুরু করলো আমার কাঙ্খিত স্বপ্নীল প্রান্তরের তরে।
সারাদিনের ব্যস্ততা আর ঝামেলা শেষ করে যখন বাস চলতে শুরু করলো মনের গহীনে যেন এক আনন্দের তরঙ্গধ্বনি বইতে শুরু করলো। জানালার পাশে বসে, দমকা বাতাসে, আধো ঘুমে, আধো জাগরণে হিমালয়ের প্রতীক্ষা গুনতে শুরু করলাম। হাজার মাইল দূরে থেকেই আমার ব্রীড়াহীন চিত্তে অনুভব করতে শুরু করেছিলাম চিরচেনা দেবভূমিকে। কালো শিলা খন্ডের উপরে শুভ্র-সাদা তুষার, তারও উপরে কাঠ কয়লার মত ঝড়ের পূর্বের কালো মেঘের মেঘমন্দ্রের কল্পনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়ালই করিনি।
ঘুম ভাঙলো বাসের তীব্র একটা ঝাকুনিতে। ততক্ষনে যশোর পৌঁছে গেছি। যশোর আসলেই সর্বপ্রথম মনে পড়ে অ্যালেন গিন্সবার্গের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের বঙ্গভাষা কবিতা দুইটা। যতবারই যশোর আসি ততবারই যশোর রোডের শতবর্ষী রেইনট্রি গাছগুলো দেখে বিমোহিত হয়ে যাই। রাস্তার দুপাশ জুড়ে মা গাছগুলো কি অপরূপতায় প্রাকৃতিক ভিস্তা তৈরী করে রেখেছে। ভোরের আধো আলোতে সেই পথ ধরে ছুটে চলেছে বাস। বেনাপোল স্থল বন্দরে যখন এসে পৌঁছাই তখন সকাল সাড়ে আটটা।
বর্ডার মানেই দালাল আর ঘুষখোরের আড্ডাখানা। কিন্তু এবারে এসব ঝামেলায় যেতে হলো না। বর্ডারে কোন ভীড়ও তেমন চোখে পড়লো না। তাই নিজে নিজেই সকল বাংলাদেশ পাশের অফিশিয়াল কাজ শেষ করে ফেললাম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। কিন্তু ভারতের পাশে গিয়ে দেখি দীর্ঘ লাইন। তবে এখানেও ঘুষের ধার ধারলাম না। লাইনে দাঁড়িয়েই একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যখন ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে ছবি তোলার জন্য গেলাম তার আড়চোখের সন্দেহের দৃষ্টি দেখেই কেমন জানি একটু খটকা লাগলো। কিন্তু নিমিষেই তা উবে যখন তিনি বললেন কোথায় যাচ্ছিস? ট্রেকিংয়ে? আসলে আমাদের কাঁধে ব্যাকপ্যাক দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমরা ট্রেকিংএ যাচ্ছি। এরপর যা ঘটলো তা অভাবনীয়। লাইন যেমন ছিল তেমন পড়ে রইলো, ইমিগ্রেশনের কাজ রেখে গল্প শুরু করে দিলেন, তার যৌবনের গল্প। কত বছর বয়সে কোথায় কোথায় গিয়েছেন। এখন কিভাবে এই কর্মজীবনে আটকা পড়ে গেছেন। গল্পে এতই মশগুল হয়ে গেলেন যে লাইনের পিছনের মানুষজন ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে তাতে কর্ণপাতই করেননি। শেষমেষ বললেন, “আচ্ছা ভালোভাবে যা। কোন সমস্যা নেই। হিমালয় কাউকে নিরাশ করেনা। আর ফেরার সময় অবশ্যই ছবি দেখিয়ে যাবি।”
ভারতের মানুষগুলোর এই একটা জিনিস আমার খুবই ভালো লাগে। তারা সহজেই তুই-তে নেমে এসে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত আচরন শুরু করে। আমরাও ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বের হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানি এক্সচেঞ্জার থেকে সাথের ডলার ও টাকা রূপিতে পরিবর্তন করে অটোতে উঠে বসলাম বনগাঁ রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
বনগাঁ স্টেশন আর দশটা সাধারণ রেলস্টেশনের মতই, হকারের ডাকাডাকি, টিকেট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন, চিৎকার চেচামেচি। পার্থক্য শুধু এই যে এখানে ওখানে পড়ে থাকা ময়লার স্তুপ নেই। এখান থেকে আন্তঃনগরীয় বিভিন্ন যায়গার ট্রেন প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ছেড়ে যায়।।আমাদের লক্ষ্য শিয়ালদহ। আর শিয়ালদহ যাবার ট্রেন প্লাটফর্মেই আছে, মিনিট দশেকের মাঝেই ছেড়ে যাবে। এই ট্রেন ধরতে না পারলে আবার একঘন্টা বসে থাকতে হবে। তাই ৮০ রূপি দিয়ে ৪ টা টিকেট করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। বনগাঁ লোকালে সাধারণত প্রচুর ভীড় হয় যা গত কয়েকবার লক্ষ্য করেছি। কিন্তু জানিনা কোন এক কারণে আজ তেমন ভীড় দেখছি না। তবে বেশ কিছু হকারের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছি। প্রচন্ড গরমে লস্যি কিনে খেলাম। লস্যি হলো টকদই, চিনি ও বরফকুচি মিশিয়ে বানানো পানীয় বিশেষ, অনেকটা আমাদের দেশের লাচ্ছির মতই। ১৫ রূপির লস্যির অতুলনীয় স্বাদ।
যথাসময়েই ট্রেন ছাড়লো। এরা ট্রেনের সিডিউলের ব্যাপারে খুবই সচেতন। এক মিনিটও দেরী হবার নয়। একের পর এক স্টেশন যাচ্ছে আর ভীড় বাড়তে বাড়তে একসময় জনারণ্য হয়ে গেল। ঠিক দুই ঘন্টায় বনগাঁ লোকাল শিয়ালদহ স্টেশনে নামিয়ে দিলো। শিয়ালদহ বা শিয়ালদা রেলস্টেশনটি শহরতলির অন্যতম প্রধান রেলস্টেশন। ১৭টি প্লাটফর্ম বিশিষ্ট শিয়ালদহ ভারতের ব্যস্ততম রেলস্টেশনগুলোর মধ্যেও একটি। এটি ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে চালু হয়। তখন এটি তৎকালীন পূর্ব বঙ্গীয় রেল বিভাগ এর আওতায় ছিল। ‘৪৭ এর দেশভাগের আগে দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ হতে রাণাঘাট, গেদে-দর্শনা পথ ধরে বাংলাদেশ এর মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি যেত। দেশভাগের সময় শিয়ালদহ ভারতের পূর্ব রেলের আওতা ভুক্ত হয় এবং অবশিষ্ট অংশ পূর্ব পাকিস্তান এর অন্তর্গত হয়।
শিলায়দহ নেমেই দেখি গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমাদেরকে ফেয়ারলী প্যালেসে যেতেই হবে আগামীকালের ট্রেনের টিকেট করার জন্য। এরপর বাকিসব কিছুর কথা চিন্তা করা যাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম। কিন্তু বিধিবাম। আজ রবিবার। তাই ফেয়ারলী প্যালেসও বন্ধ। নিরুপায় হয়ে আগামীকাল সকালে খোঁজ নেয়া যাবে ভেবে হোটেলের সন্ধানেই বের হলাম। ততক্ষণে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। একেই তো রবিবার, সবকিছু বন্ধ; কলকাতা শহরটা যেন এই মধ্যদুপুরেও ঘুমিয়ে আছে। তার উপরে পথঘাট ভাসানো এই ঝুমবৃষ্টি যেত শীতলতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, মনকে রোমাঞ্চিত করে তুলছে। এই বৃষ্টিতে হোটেল খোঁজার কোন মানেই হয় না। তাই ট্যাক্সিওয়ালার পরিচিত নিউমার্কেট এলাকার একটা হোটেলেই গিয়ে উঠলাম। দুইহাজার রূপিতে ৪ জনের জন্য এসিরুম পেয়ে খুব বেশি ঠকেছি বলে মনে হলো না।
এই মুহূর্তে ট্রেনের টিকেটের চিন্তা সবচেয়ে বড় চিন্তা। কারণ আগামীকাল টিকেট না পেলে আরও একদিন কলকাতা বসে থাকতে হবে। কিন্তু এসবের চিন্তায় সারাদিন যে খাওয়াই হয়নি সেকথা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। টের পেলাম রুমে গিয়ে হাত মুখ ধোয়ার পরে। হোটেলের সামনেই বিরিয়ানির দোকান। তাই দেখে পেটের খিদের চেয়েও চোখের খিদের আকর্ষিকতা এতই বেড়ে গিয়েছিলো যে এক একজন দুই প্লেট করে বিরিয়ানি খেয়ে ফেললাম।
এরপর জানতে পারলাম নতুন সংবাদ। সুদীপ্ত-অমৃতার কোন এক দাদার বন্ধু এসেছে আমেরিকা থেকে কলকাতা বেড়াতে। সেই আমেরিকানও আমাদের সাথে নাকি যাবে। আমেরিকান মানুষ বেশ শক্ত সামর্থই হবে। ট্রেকে অন্তত কোন ঝামেলা হবে না। তাছাড়া ওদের দুইজনের কিছু ভারও আমার আর সুপ্তর উপর থেকে কমবে। এসব ভেবেই জানিয়ে দিলাম গেলে যাবে, কোন সমস্যা হবে না। এদিকে হোটেলের ম্যানেজারকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম আমাদের জন্য টিকেটের কোন ব্যবস্থা করতে পারে কিনা দেখতে। সেও এসে জানিয়ে গেল আগামীকাল রাতের দুন এক্সপ্রেসের টিকেট পাওয়া যাবে। এবার একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
অসম্ভব ব্যস্ত ও ক্লান্তিকর একটা দিনের শেষে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসতে শুরু করলো শহরতলির বুক জুড়ে। বৃষ্টিও থেমে গেছে অনেকক্ষণ হলো। এবার পূর্বচেনা এই শহরটাকে একটু দেখতে বের হওয়া যেতেই পারে। কলকাতা শহরের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই শররের দেমন কিছুই আমি এখনও চিনি না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের এত এত বই পড়েছি যে পুরো শহরটাই চোখের সামনে একটা ছবির মত হয়ে আছে। কিন্তু কোনবারই আমার হৃদয়পটের সেই ছবির সাথে বাস্তব কলকাতার মিল পাইনা।তবুও সন্ধ্যার পর আবার দেখতে বের হলাম। কেমন আছে সমরেশ-সুনীলের গড়ের মাঠ - গড়িয়ার হাট, শ্যামবাজার- ধর্মতলা-চৌরঙ্গী? কেমনইবা আছে অর্কের ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তি?
কলকাতা এলে প্রতিবারই আমার একটা জিনিস দেখতে হবেই- ট্রাম। আর যতবারই ট্রাম লাইন দেখি আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এই ট্রাম লাইনইতো আমার জীবন থেকে অনেকগুলো কবিতা কেড়ে নিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে জীবননান্দ দাশের জীবন। এসব কাব্যিকতা মনের গহীনেই লুকায়িত রেখে তালতলার এক দোকানে চাওমিন, মমো খেয়ে, ট্রাম লাইন ধরে হাটতে হাটতে আবার হোটেলে ফিররে এলাম। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম ঠান্ডা ঘরের নরম বিছানায়।