পরদিন ঘুম ভাঙলো একটু বেলা করেই। আজকেই রওনা হয়ে যাবো। বুকজুড়ে অদ্ভুত এক ব্যথা, কাব্যিক এক অনুভূতি, অজানা সেই পথ চলা। দূর আকাশে কল্পনাতে আঁকা প্রেয়সীর মুখ আর অপরিসীম প্রতীক্ষার প্রহর। তবুও সময় হাতের তালু দিয়ে অলক্ষ্যে ঝড়ে যায় বালুর মতন। অপেক্ষা করে বসে থাকলেই চলবে না। সুদীপ্ত-অমৃতা যেহেতু নতুন, ওদের জন্য তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগসহ বেশ কিছু কেনাকাটা করতে হবে। তাছাড়া আমাদের সবারই কিছু না কিছু কিনতে হবে। আর এসবের জন্য ডিক্যাথলনের পরিপূরক কিছু নেই। কলকাতায় ডিক্যাথনের যে শোরুম আছে সেটাও বেশ দূরে। ট্রেন রাত সাড়ে আটটায়, টিকেট পাবো সন্ধ্যা ছয়টায়। আর আগে গিয়ে আসতে হবে।

এদিকে সেই আমেরিকানও সকাল সকাল তার ইয়া বড় ব্যাকপ্যাক নিয়ে হোটেলে এসে হাজির। বেশ হাশিখুশি, প্রানবন্ত ৩২ বছরের এক যুবক জন। মাথায় লম্বা চুল, মুখে লম্বা দাড়ি, প্রথম দেখাতে যে কারো মনে হবে এ যেন কোন রক ব্যান্ডের সদস্য। পরিচয় পর্ব সেরে নিয়ে, সকাল ও দুপুরের খাবার একসাথে সেরে দুপুর ১২ টায় হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে আরও প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে উলুবেড়িয়ার ডিক্যাথলনের শোরুম।

পথ চেনা না থাকায় একবার বাস, একবার ট্রেন ও একবার অটোতে চড়ে দুপুর তিনটার দিকে পৌঁছে গেলাম। ডিক্যাথলনের শোরুম দেখে বুঝলাম চক্ষু চড়কগাছ বলতে এতেই বোঝায়। কি নেই সেখানে? একজন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ও ক্রীড়াবিদ মানুষের কাছে এ যেন স্বর্গ। পুরোটা ঘুরে দেখতেই ঘন্টাখানেক চলে গেল। কিন্তু আমাদেরতো ফিরে ট্রেন ধরতে হবে। তাই হুড়োহুড়ি করে শেষ মুহূর্তে সব কিনে আবার ফিরে আসার জন্য পক বাড়ালাম কলকাতার দিকে। আসার সময় অটোওয়ালার কাছ থেকে রাস্তা জেনে নেয়ায় এবার আর বেগ পেতে হলো না। এক বাসেই ধর্মতলা পৌঁছে গেলাম সন্ধ্যা ছয়টার দিকে।

ট্রেনের বাকি মাত্র আড়াই ঘন্টা। এখনও সেই হোটেলে গিয়ে টিকেট নিয়ে আবার হাওড়া রেল স্টেশন যেতে হবে। হোটেলে গিয়ে দেখি আমাদের টিকেট আগে থেকে তৈরী করে রাখাই ছিলো। তাই আর বিলম্ব না করে সাতটার দিকে ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম হাওড়ায়। ট্যাক্সি নিতে গিয়ে পড়লাম বিড়ম্বনায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়ম করে দিয়েছেন এক ট্যাক্সিতে ৪ জনের বেশি মানুষ নেয়া যাবে না। কিন্তু আমরা তো পাঁচজন। আর যেহেদে আমাদের কাছে মাত্র একটাই সিম আছে তাই দুইটা ট্যাক্সি নিলেও সবাইকে স্টেশনে খুঁজে পেতেও ঝামেলা হতে পারে। তারপরেও ওদের তিনজনকে একটা ট্যাক্সিতে আগে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করতে বলে আমি আর সুপ্ত অন্য ট্যাক্সিতে রাত আটটার মাঝেই স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ওদেরকে খুঁজে বের করে, রাতে খাওয়ার জন্য চাওমিন আর পেপসি কিনে, প্লাটফর্মে ঝোলানো প্যাসেঞ্জার লিস্ট থেকে নিজেদের বগি খুঁজে বের করে যখন ট্রেনে গিয়ে উঠি তখন আটটা পঁচিশ।

ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই সাড়ে আটটায় ট্রেন ছেড়ে দিলো অমৃতলোকের পথে। শেষ হতে চলেছে আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর। অতীতের অভিজ্ঞতার রঙিন স্মৃতিতিগুলো আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আবার নতুন করে আমাকে উদ্দীপ্ত করছে, সজাগ করছে।

ট্রেন ভ্রমন সবসময়েই রোমাঞ্চকর। কোন কাজ নেই, চিন্তা নেই। সারাদিন বসে বসে জানালায় মুখ রেখে একের পর এক পিছনে চলে যাওয়া গ্রামগুলো দেখা, কখনো সবুন বনবিথী, কখনো ধূ ধূ করা প্রান্তর আবার। কখনো নদী- গ্রাম বাংলার চিরচেনা প্রকৃতি। সাথে আয়েশ করে বই পড়া, আড্ডা দেয়া আর সব স্টেশনে নেমে নেমে এটা ওটা কিনা খাওয়া। কিন্তু এতো দীর্ঘ ভ্রমন কখনও কখনও বিরক্তিকরও হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যখন জানালার পাশে বসে কিংবা দরজায় পা নাচাতে নাচাতে সিগারেট ফুঁকতে না পারা যায়। ট্রেনের ভেতরে কিংবা স্টেশনে ধুমপান করতে দেখলেই দরে জরিমানা করে দেবে। একমাত্র উপায় টয়লেটে গিয়ে ছোটবেলার মত লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়া নয়ত কোন ক্রসিংয়ে ট্রেন থামালে নিচে নেমে খাওয়া। আগামী কয়েকদিনের জন্য এতটুকু তো বিসর্জন দেয়া যেতেই পারে। দুদিন পরেই তো কোন এক গোধূলি লগনে আলোর বর্ণালী দেখতে দেখদে ধোয়াশা তৈরী করতে পারবো।

প্রথম রাতটা দেখতে দেখতেই চলে গেল। রাতে জম্পেশ ঘুমও হলো একটা। পরদিন ঘুম ভাঙলো সার্ভিস বয়ের ডাকে। খাবারের জন্য বলে দিতে হবে নয়ত সারাদিনেও নাকি আর খাবার পাওয়া যাবে না। ঘুমের ঘোরেই কি জানি প্লেটার অর্ডার করে দিলাম। পরে খেতে গিয়ে বুঝলাম এমন জঘন্য খাবার স্মরণকালে কখনও খাইনি। পেটে খিদে নিয়ে দুপুর পর্যন্ত বসে আছি এরই মধ্যে কে জানি বলে উঠলো আমাদের ট্রেন লখনৌ হয়ে যাবে। আর লখনৌ মানেই বিরিয়ানি। লখনৌ পৌঁছালেই বিরিয়ানি কিনে পেটপুজো করা যাবে। লখনৌ পৌঁছানোর সিডিউল টাইম বিকেল ৫ টা। ততক্ষন না কেয়ে থাকতে হবে ভেবেও বিরিয়ানির লোভে পেটে পাথর চাপা দিয়ে রাখলাম। কিন্তু ৫ টা যায়, ৬ টা যায়, খিদে কমাতে খানিক পর পর বাথরুমে গিয়ে পালা করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা সিগারেটও শেষের পথে কিন্তু লখনৌ আর আসে না। অবশেষে বিকেল ৫ টা সিডিউল টাইমের ৫ ঘন্টা দেরী করে রাত ১০ টায় ট্রেন লখনৌ স্টেশনে পৌঁছলো।

ট্রেনতো আসলো কিন্তু কোথায় বিরিয়ানি? কিসের বিরিয়ানি? পুরো স্টেশন ঘুরেও কলার স্তুপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। খুঁজতে খুঁজতে এমন অবস্থা হলো যে ট্রেনই ছেড়ে দিলো। উপায়ন্তর না পেয়ে একগাদা কলা নিয়েই অন্য বগিতে উঠে পড়লাম। ভীড় ঠেলে ঠুলে নিজেদের কামরায় এসে সে কলা আর গলা দিয়ে নামে না। কিন্তু একটা রাতই তো। কাল হরিদ্বার নামলে পরে আমার নাওয়া-খাওয়া সব উবে যাবে। কাল থেকেই শুরু হবে আমার যাত্রা সেই প্রান্তরজুড়ে, হৃদয় যেখানে ভয়শূন্য, শির যেখানে সমুন্নত, জ্ঞান যেখানে মুক্ত সেই হিমালয়ের ছায়া প্রাঙ্গণতলে। ইচ্ছে ছিল ট্রেন থেকে নেমে কালই আমাদের ট্রেকের বেজক্যাম্প লোহাজং বা ওয়ান পৌঁছে যাবো। ট্রেন পৌঁছানোর কথা ভোর ৪ টায়। সকাল সকাল শুরু করলে অবশ্যই পৌঁছানো সম্ভব হতো। কিন্তু ৫ টায় যায়গায় যখন লখনৌ আসতে ১০ টা বেজে গেছে অতএব আমরা ইতিমধ্যেই ৫ ঘন্টা লেট। মনে হচ্ছে না কাল বেজক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হবে। তখন কি করব, কোথায় কি থাকলে ভালো হবে এসব পরিকল্পনা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে ট্রেন হরিদ্বারে পৌঁছালো। চারপাশে ছোট পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটা শহর। হরিদ্বারকে কখনও কখনও ‘হরদ্বার’ বা ‘হরদুয়ার’ ও বলা হয় যার অর্থ ঈশ্বরের দুয়ার। এটি উত্তরাখন্ড রাজ্যের একটি জেলা ও হিন্দু ধর্মালম্বীদের একটি প্রধান তীর্থস্থান। মূলত অনেক হিন্দু মন্দির ও তীর্থস্থান আছে বলে পুরো উত্তরখন্ডকেই ‘দেবভূমি’ বা ‘দেবতাদের দেশ’ বলা হয়। তাছাড়া হিমালয়, ভাবর ও তরাই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও এই রাজ্য বিখ্যাত।

উত্তরখন্ড রাজ্যটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে- গাড়োয়াল ও কুমায়ুন। গাড়োয়াল বিভাগকে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে কেদারখন্ড ও কুমায়ুনকে মানসখন্ড বলা হয়ে থাকে। হরিদ্বার জেলাটি গাড়োয়াল বিভাগের অন্তর্গত। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিলাচিত্র, পাথরের ছাউনি, প্রত্নতাত্ত্বিক পাথরের যন্ত্রপাতি গবেষনা করে দেখা গেছে এই পার্বত্য অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগেও জনবসতির অস্তিত্ব ছিল। এমনকি এখানে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় বৈদিক যুগে এই অঞ্চল কুরু ও পাঞ্চাল মহাজনপদের অংশ ছিল। এবং এই অঞ্চলের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজবংশটি ছিল কুনিন্দ রাজবংশ। কলসিতে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপি থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মেরও অস্তিত্ব ছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে পৌরব, কুষাণ, কুণ্ডিন, গুপ্ত, গুর্জর-প্রতিহার, কাত্যুরি, রাইকা, পাল, চন্দ, পানোয়ারের পারমার, শিখ ও ব্রিটিশরা এই অঞ্চল শাসন করে গেছে।

আপাতত এসব ইতিহাসে কপচানো রেখে বাসের সন্ধানে বের হলাম। ওদিকে গতকাল লখনৌ বিরিয়ানির নামে কলা খেয়ে সারারাত কাটিয়ে পেটও চোঁ চোঁ করছে। অনেক ঘুরে ফিরে একটি বাস পাওয়া গেল যেটি ১১ টার দিকে ছেড়ে শ্রীনগর পর্যন্ত যাবে। বাকি সব কিছুই অনেক ভোরে চলে গেছে নয়ত পৌঁছাতে পারবে না। হরিদ্বার থেকে লোহাজং মোটামুটি ১০-১২ ঘন্টার পাহাড়ি পথ। এই পথে রাতে গাড়ি চালানোর ঝুঁকি কেউই নিতে চায়না। বুঝে গেলাম আমাদের আজ আর লোহাজং পৌঁছানো হবে না, বড়জোর কর্ণপ্রয়োগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি। সেই পরিকল্পনামাফিক বাসের টিকেট কেটে পেটপুজো করতে চললাম। লুচি, আলুর দম ও ডিম দিয়ে গতকাল থেকে পুষে রাখা খিদেটাকে নিস্তার দিলাম। এরই মাঝে সুপ্ত ঘটালো আর এক বিপত্তি। নাস্তা শেষ করে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা মেনথল সিগারেট খাচ্ছিলো ও। হঠাৎই এক বুড়ো পাগল এসে ওর কাছে সিগারেট চাইলে ও আধপোড়া সিগারেটটাই দিয়ে দিলো। এখানকার মানুষের মেনথলে অভ্যাস না থাকায় সে পাগল সিগারেটে একটা টান দিয়েই সে কি কাশি, সাথে সুপ্তকে গালি। আমরা পাশে বসে বেশ মজা পাচ্ছিলাম আর হাসছিলাম। তা দেখে পাগলটা গেলো আরও ক্ষেপে। পাগলকে পাশ কাটিয়ে বাসে উঠে বসতেই বাস ছেড়ে দিলো।

যে কোন ভ্রমনেই জানালার পাশের সিটটা আমার জন্য স্বর্গীয় আসন। আর এ ব্যাপারে সুপ্তর কোন খুতখুতানিই নেই। ট্রেনে বসে গরমের কারণে একটু আকটু খুতখুত করলেও বাসে জানালার পাশের সিটটা আসার জন্য অবলীলায় ছেড়ে। ভাগ্যক্রমে বসেও ছিলাম ডানপাশের সিটে। বাস চলতে শুরু করল আঁকাবাকা পথ ঘেষে। খানিক বাদেই দিল্লী হইওয়ে। সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে দিল্লীর দিকে। বামদিকের গঙ্গানদীর উপরের ব্রীজ পাড়ি দিয়ে অন্য রাস্তা চয়ে গিয়েছে হৃষিকেশের দিকে। এখানে থেকেই মূলত পাহাড়ি রাস্তার শুরু। গঙ্গা এখানে শুষ্কপ্রায়। যতদূর চোখ যায় দেখা যায় রাশি রাশি পাথরের ধূ ধূ প্রান্তর। বর্ষাকালেই এখানে ঢল নামে, গঙ্গা ফিরে পায় তার যৌবন। এর পর থেকেই পুরোটা পথজুড়ে গঙ্গা নিত্য সঙ্গী। কিন্তু হৃষিকেশের আগে বাঁধ দিয়ে চলছে গঙ্গার স্রোতকে নিয়ন্ত্রন করার প্রচেষ্টা। নদীর দুই পাশ সান বাঁধানো। দেখে মনেই হয় না স্রোতস্বিনী গঙ্গা একটি পাহাড়ি নদী।

হরিদ্বার থেকে হৃষিকেশের দুরত্ব ২০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে মোটামুটি ১ ঘন্টা। পাহাড়ি, জঙ্গলাকীর্ণ, উচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের বাস যখন হৃষিকেশে ঢুকেছে ততক্ষণে গরমে শরীর জ্বালা করতে শুরু করেছে। হৃষিকেশ থেকেই ধরা হয়ে থাকে গাড়োয়াল হিমালয়ের শুরু। কিন্তু এতো গরমে মনেই হচ্ছে না হিমালয় অঞ্চলে আছি। ফোনের স্ত্রিনের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখি তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেই স্থির হয়ে আছে।

হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রমতে হৃষিকেশ ভারতের অন্যতম পবিত্র শহর। কথিত আছে ভগবান বিষ্ণুর এক অবতারের নামানুসারে হৃষিকেশ নামকরণ করা হয়েছিল। হৃষিকেশে তীর্থযাত্রী ও পর্যটক উভয় ধরনের মানুষই এসে থাকেন। পর্যটকগন আসেন মূলত ইয়োগার জন্য। হৃষিকেশকে বলা হয় ইয়োগের রাজধানী। আমাদের বাস হৃষিকেশের শত শত গাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলেছে আর আমাদের চোখে পড়ছে শত শত ইয়োগা ও যোগ সাধনার প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও র‍্যাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং, বাঞ্জি জাম্পের মত অ্যাডভেঞ্চার এক্টিভিটিস শপ যেমন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন দূরবর্তী তীর্থস্থানে ভ্রমনের সুবিধার্থে এজেন্সীর সংখ্যাও উল্লেখ্যযোগ্য। হৃষিকেশের গঙ্গা শান্ত নিরব। কুলুকুলু ধ্বনিতে বয়ে চলেছে নিচের দিকে। এখানে গঙ্গার জলের রং আকাশের মত নীল। চারদিকে সুউচ্চ পাহাড়। কিছুটা দূরে গঙ্গাতটে তপস্যারত সাধুরা যোগাসনে বসে আছেন। শহরটাকে এক দেখাতেই এতটা ভালো লেগে গেল যে ঠিক করে ফেললাম ফেরার সময় অবশ্যই একদিন এখানে থাকতে হবে। এরই মধ্যে আমাদের বাস হৃষিকেশ শহর ছাড়িয়ে চলেছে শ্রীনগরের দিকে।

হৃষিকেশ ছাড়িয়ে গঙ্গাকে হাতের ডানে রেখে আড়াই ঘন্টার মত চলে পৌঁছালাম দেবপ্রয়োগ- গঙ্গার উৎপত্তিস্থল। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ ধর্মীয় স্থান। পঞ্চপ্রয়োগের একটি দেবপ্রয়োগ। ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে মুখস্ত করা ‘হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ থেকে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা নদী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে’ কে কতটা সীমাবদ্ধ জ্ঞান তা এখানে না আসলে বুঝা দ্বায়। গঙ্গা শুধু গঙ্গোত্রী হিমবাহই নয় বরং গঙ্গোত্রী, সতোপন্থ ও খাটলিং হিমবাহ এবং নন্দাদেবী, ত্রিশূল, কেদারনাথ, নন্দাকোট ও কামেট শৃঙ্গের বরফগলা পানির ধারা। গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে সৃষ্ট ভাগীরথী নদী ২০৫ কিলোমিটার ও সতোপন্থ হিমবাহ থেকে উৎপন্ন অলকানন্দা নদী ১৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই দেবপ্রয়োগে এসে মিলিত হয়ে গঙ্গা নামে শুরু করেছে তার দীর্ঘ পরিক্রমা। সাথে এর অববাহিকায় স্থান দিয়েছে প্রায় ৪০ কোটির বিশাল জনগোষ্ঠীকে৷ বইয়ের পাতার থেকে মুখটা তুলে সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে বিস্তৃত করার জন্যই তো এই দুর্গমে ছুটে চলা। এই তো জীবনের মানে।

রাশি রাশি পাহাড়ের পাদদেশ ধরে বয়ে চলা আলকানন্দা নদীর সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে, ১৩৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যখন শ্রীনগরে এসে পৌঁছাই তখন ঘড়িতে বেলা সাড়ে তিনটা। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে অনেকটাই। এসব পাহাড়ের রাজ্যে সন্ধ্যেটা নেমে আসে হুট করেই। পাহাড়ের আড়ালে হুট করেই সূর্যটা ডুব দিয়ে আঁধার ঘনিয়ে আসে। নিয়ে আসে নিঝুম নিস্তব্ধতা। শ্রীনগর থেকে আমাদের গন্তব্য লোহাজংয়ের দুরত্ব এখনও ১৪৬ কিলোমিটার। গুগল ম্যাপের মতে পাহাড়ী রাস্তায় এই পথ পাড়ী দিতে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা তো লাগবেই। কোন ড্রাইভারও রাতে গাড়ী চালাতে সম্মতি না জানানোয় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম ৬৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কর্ণপ্রয়োগে গিয়ে থাকবো। পরদিন খুব ভোরে রওনা দিয়ে লোহাজং পৌঁছে ট্রেকিং শুরু করব। তাহলে মূল পরিকল্পনা থেকে আর পিছিয়ে থাকতে হবে না।

পরিকল্পনা মাফিক কর্ণপ্রয়োগের গাড়িতে চেপে বসলাম। এখনও আমাদের পথ চলার নিত্যসঙ্গী অলকানন্দা। হাতের বামে বয়ে চলা নীল নির্ঝরিনী বুকে কাপন ধরিয়ে দেয়। অস্তাচল সূর্যের রক্তিম আলো অলকানন্দার নীলাভ বুকে প্রতিফলিত হয়ে অপার্থিব রূপে আমাদের চোখে ঝিলিক দিচ্ছে। বিশাল পাথরের চাঁইয়ের উপর বসে মাছ ধরার দৃশ্যও চোখে পড়ার মত। প্রায় ঘন্টাখানেকে ৩৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রুদ্রপ্রয়োগ। রুদ্রপ্রয়োগ হলো সেই যায়গা যেখানে নীল অলকানন্দা আর ধূসর-ঘোলাটে মন্দাকিনী নদী মিলত হয়ে অলকানন্দা নামে বয়ে চলেছে। উত্তরাখণ্ডের সতোপন্থ এবং ভাগীরথ খড়ক হিমবাহের পাদদেশে থেকে উদ্গত হয়ে, ২১ কিলোমিটার দুরের তিব্বত থেকে আগত উপনদী সরস্বতী নদীর সঙ্গে মানায় মিলিত হয়েছে। মানা থেকে আরও তিন কিলোমিটার দূরে হিন্দু তীর্থযাত্রা বদরিনাথ এর আগে অলকানন্দা নামে প্রবাহিত হয়েছে। সতোপন্থ হিমবাহে অলকানন্দার উৎস থেকে ছয় কিলোমিটার উঁচুতে এর স্নাউটের কাছে ৪৩৫০ মিটার উচ্চতায় ত্রিভূজাকৃতি সতোপন্থ হ্রদ আছে। এর নামকরণ করা হয় হিন্দু দেবতাত্রয়ী ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের নামে। অলকানন্দার পথ পরিক্রমায় এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরও পাঁচটি প্রধান উপনদী - ধৌলিগঙ্গা, নন্দকিনী, পিন্ডার, মন্দাকিনী ও ভাগীরথী। দেবপ্রয়াগের শেষ উপনদীতে মিলিত হওয়ার পর এটি গঙ্গা নামে পরিচিত।

অন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া এসব তথ্যের সাথে চাক্ষুষ দর্শন মিলিয়ে দেখতে দেখতে শেষ বিকেলের রক্তিম আলোয় ছুটে চলেছি কর্ণপ্রয়োগের দিকে। কর্ণপ্রয়োগ যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা ৬ টা। জীপ থেকে নামতেই মৃদু ঠান্ডা হাওয়ার আলতো স্পর্শে শরীর শিহরন জেগে ওঠে৷ স্টিলের ব্রীজটা পার হয়েই দুইটা রাস্তা চলে গিয়েছে দুই দিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে একটা রাস্তা সোজা উঠে গিয়েছে নন্দাপ্রয়োগ, চামোলী পেরিয়ে জশীমঠের দিকে। অন্য একটা ব্রীজ পার হয়ে সমতল রাস্তাটা চলেছে থারালি হয়ে লোহাজংয়ের পথে। এই রাস্তাটাই আমাদের গন্তব্য। এখান থেকে লোহাজংয়ের দুরত্ব ৮১ কিলোমিটার। পাড়ি দিতে সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার মত। যেহেতু এই রাতে আর কোথাও যাওয়ার উপায়ন্তর নেই, তাই আগামীকাল ভোরে যেন কোন ঝামেলা ছাড়াই রওনা হতে পারি তাই আগে থেকেই রাস্তাটা চিনে নিয়ে চললাম থাকার যায়গার সন্ধানে।

চাইলেই কোন হোটেলে গিয়ে উঠে পড়তে পারি। কিন্তু একটু অ্যাডভেঞ্চারের ঝোঁক সামলানো দায়। মাথার মধ্যে চলছে অন্য পরিকল্পনা। অলকানন্দা ও পিনধারী নদীর সঙ্গমের জায়গাটায় তাঁবু করে থাকার জন্য বড়ই লোভ হচ্ছে। কিন্তু রাতে কোন ঝামেলা হবে কিনা কিংবা কোন নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা সেটা আগে জেনে নেয়া দরকার। স্থানীয় দোকানের লোকজনের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিলাম কোন সমস্যা নেই। এবার আর কোন বাঁধাও তবে নেই। ব্যাকপ্যাক নিয়ে নেমে পড়লাম নদীর কিনারে, সুবিধামত একটা জায়গা দেখে তাঁবু খাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু রাশি রাশি পাথরের উপর তাঁবু খাটানো মোটেই সহজ কোন কাজ নয়। তাঁবু পিচ তো করাই যাবে না, যদিওবা যায় ঘুমাতে আর হবে না। তাই অগত্যা একটু দূরে তাঁবু টাঙিয়ে দিলাম।

ইতিমধ্যে রাত নেমে এসেছে সমস্ত চরাচরজুড়ে৷ দূরে কর্ণপ্রয়োগ শহরের আলোগুলোর মিটিমিটি হাসি আর বয়ে চলা অলকানন্দার কলকল ধ্বনিতে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে। রাত না বাড়লেও শহরটা যেন এরই মধ্যে মিইয়ে পড়েছে। তাঁবুর পিছনের খাঁড়া ঢাল দিয় ক্ষানিক পর পর গড়িয়ে পড়া ছোট ছোট পাথরের টুকরোগুলো কেমন যেন গা ছমছমে একটা আবহাওয়া তৈরী করছে। চোর বা এ জাতীয় উটকো ঝামেলা করা মানুষের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারছি না। সবকিছু ফেলে রেখে রাতের খাবার খেতে যাওয়া ঠিক হবেনা মনে করে দুইটা ভাগে ভাগ হয়ে একে একে খাওয়া শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর সুপ্ত থেকে গেলাম বাকিদের খেতে পাঠিয়ে। বাকিরা আসার পরে আমরা।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে পাথরের চাঁইয়ের উপর বসে শুরু হলো গল্প। জহির রায়হান হলে হয়তো বলতে পারতেন, ‘রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরোনো সেই রাত।’ সমস্ত উপত্যকা জুড়ে হাজার বছর ধরে বয়ে চলা পিনধারী নদীদে পা ডুবিয়ে চলতে থাকলো হাজার বছরের হিমালয়ের গল্প। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো ঠান্ডার প্রকোপ। শেষ পর্যন্ত গল্পের ইতি টেনে ঢুকে পড়লাম স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে। চন্দ্রহারা আকাশে কোটি কোটি তারকারাজি যেন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো আমাদের।


রুপকুন্ডের রুপ ও একটি হিমালয়ান উপাখ্যান-১