শরীরটা এখনো ভালো না। থেকে থেকেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। চার দেয়ালের রুমটা ছেড়ে বের হয়েছি অনেকদিন পরে। অনেকদিনের ঘরবন্দী মানুষ হটাত বের হয়ে আকাশ দেখলে আকাশের বিশালতা তার ভালো লাগে। সে বিশাল নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কি কি যেন ভাবতে পারে আনমনে। টং এ বসলাম চা খেতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। গত ছয় বছরে আপন বলতে এই চা আর সিগারেট। অনেকে ছেড়ে গেছে অনেককে ছেড়েছি, শুধু ছাড়তে পারিনি এই দুই জিনিস। পাশেই রাস্তায় ছুটে চলছে অনেক মানুষ। রিকশায় কিছু কপোত-কপোতি হুড তুলে মুখ লুকিয়ে যাচ্ছে। সেগুলোও যেন কিছু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তারা এভাবেই যাবে যেন আমি জানতাম।

ফোন দিলেও এখন কেউই আসবে না আড্ডা জমাতে। আজ শুক্রবার। তারা আজ বাসায় বসে বসে গত ছয়দিনের হিসেব মেলাচ্ছে। হটাৎ চোখে পড়ল দূরে দুইটা বাচ্চার উপর। বাচ্চা দুটোকে চিনি বলে মনে হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। শিশু দুটির একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। এই হয়েছে আর এক যন্ত্রনা। হঠাৎ করে ভুলে যাওয়া কিছু মনে করতে গেলেই মাথায় তীব্র যন্ত্রনা হয়। বাচ্চা দুইটার পায়ে কাছে একটি কুকুর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, ট্রাফিকের এত কোলাহলের মাঝেও। দুজন পথশিশু কুকুরটার মাথার উপর বেদিতে বসে কড়া পাহাড়া দিচ্ছে, কেউ যাতে বিরক্ত করতে না পারে।

কিছুক্ষণ ধরে দূর থেকে অন্য আরেকটি বাচ্চা কুকুরটির গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মারছিলো মেয়ে বাচ্চাটি হাঁক ছেড়ে দাবড়ানি দিয়ে বাচ্চাটিকে এলাকা ছাড়া করলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ছেলে শিশুটি ছুটে এসে ব্যথায় ঘুম ভেঙে যাওয়া কুকুরটির গলা জড়িয়ে ধরলো, কি যেনো বলে চললো কানে কানে, ঘাড়ে-গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, ঢিল যেখানটায় লেগেছিলো বারেবারে আদর করে দিতে লাগলো সেখানটায়। কুকুরটি চোখ বুজে এলো, মাথা ফেলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো আবার। ছেলেমেয়ে দুটি বেদিতে উঠে পাহারায় বসলো আবার। আমিও নতুন কিছু শিখলাম আজ আবার।

এইতো মনে পড়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোকেই আমি চিনি। নরম কিছিমের মানুষ পেলে সর্বশক্তিতে পা জড়িয়ে ধরে, ধরেই রাখে, টাকার জন্য। মারুক, ধরুক, চেঁচাক পায়ের নিচে পড়ে থাকাই এদের স্বভাব। আজ তাদের পায়ের নিচে একটি নিরীহ প্রাণ পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। যারা নিজেরাই দুনিয়ায় নিষ্ঠুরতার শিকার তারা আরেকটি প্রাণকে বাঁচাচ্ছে নিষ্ঠুরতার হাত থেকে। আজ হয়তো কারো পা ধরা হয়নি, পেটে ভাতও হয়তো জুটবে না। কিন্তু তাতে কি? মায়া জন্মে গেছে যে আরেকটি অবহেলিত প্রাণের প্রতি।

আবার আর একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখলাম গতকাল বনানী ট্রাজেডিতে। একটা পানির পাইপের উপর বসে আছে। সর্বশক্তিতে চেপে ধরছে ফাটা পাইপের জোড়া লাগানো জায়গাটিতে। যেন তার শখের খেলনাটি কেউ নিয়ে যাচ্ছে আর সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, আকড়ে ধরছে সেটি বাঁচাতে। এইজন্য তাকে কেউ কেউ বাহবা দিলেও রাতের খাবারটা তার মুখে তুলে দিবে না। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে মাতামাতি চলছে তাও কোনদিন তার হয়ত চোখেও পড়বে না। তবু তার সর্বস্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে যেন জোড়াটা ছুটে না যায়।

যখন বুদ্ধিলোপ পাওয়া একটি শিক্ষিত জাতি ব্যস্ত উদ্ধার অভিযানে বাঁধা দিয়ে কিছু লাইক কমেন্ট পাওয়ার আশায় ছবি তুলতে তখন এই ছেলেটি ব্যস্ত কারও জীবন বাঁচাতে। সেইসব শিক্ষিত মানুষদের জীবন বাঁচাতে যাদের প্রতিদিনকার নিষ্ঠুরতার নির্বাক সাক্ষী সে। এই ছেলেটিকেও আমি চিনি। বনানীতে ক্লাস করার সময় মাঝে মাঝে দেখা হতো। বাচ্চাদের বর্ণমালার বই বিক্রি করতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো, ‘নিজে তো পড়তে লেখতে পারি না, এর লাইগা চাই অইন্য কাউরে যেন পড়াইতে পারি। ভাত তো দুইডা আপনাগো কাছে চাইলেই দ্যান।’ যেদিন বিক্রি ভালো হতো না এসে বলতো ‘ভাইয়া, এক প্লেট খিচুড়ি কিনা দিবেন?’ কখনও দিতাম, কখনও দিতাম না। আমার মত আরও অনেক মানুষের কাছেই হয়ত দুইটা খাবারের জন্য হাত পাততো। আমার মত অনেকেই হয়ত তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতো। আজ তাদের জীবন বাঁচানোর জন্যই সে পথে বসে আছে, যুদ্ধ করে যাচ্ছে। নিষ্ঠুরতার কি নির্মম প্রতিদান! নীরবে কি গভীর শিক্ষা!

কতই বা বয়স হবে এই বাচ্চাগুলোর? পাঁচ, সাত বা বড়জোর দশ? স্কুল দূরে থাক, এখনো হয়তো একটি অক্ষরও শিখতে পারে নি। কেউ শেখায়ই নি। তাতে কি? প্রকৃতি তাদের নিজের হাতে ধরে শেখায়। আমরা তাদের ভালোবাসা না দেই, তাতে কি? ভালোবাসতে তারা ঠিকই শিখে যায়। ভালোবাসাটা যে সহজাত। শিখাতে হয় না। প্রতিটি নিষ্ঠুর আঘাত তাদের নতুন করে ভালোবাসতে শেখায় প্রতিদিন।


ফিচার ছবিঃ Harjeet Singh Narang