পরিচিত অনেককেই আমি মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন করি- ‘এমন একটা জিনিসের নাম বলো যেটা ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না’। বেশিরভাগের উত্তর থাকে- ঘুরতে যাওয়া। কারণ তাদের ধারণা আমি আমার ভবঘুরে জীবনটাকেই অনেক বেশি পছন্দ করি। আসলেও তাই। কিন্তু তাই বলে এমন নয় যে ভ্রমন ছাড়া আমি বাঁচতেই পারবো না। সত্যি বলতে কি আমি কখনো ঘুরতেই যাই না। বজ্রাহত হওয়ার মত অবস্থা তাই না? কি ডাহা মিথ্যা কথাটাই না বলছি। কিন্তু এখন আমি আসলেই ঘুরতে যাই না। এক সময় যেতাম। তখন বন্ধুদের নিয়ে আজ সুন্দরবন, কাল বান্দরবন, পরশু সাজেক। কিন্তু একটা সময় বিষন্নতাই হোক, হতাশাই হোক কিংবা প্রকৃতির নিয়মই হোক- জীবন দর্শনটা পুরোপুরি বদলে গেল।

বিখ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউন তার ল্যাংডন সিরিজের সর্বশেষ বই ‘অরিজিন’-এ আমাদের জীবনের দুইটি মৌলিক প্রশ্নের কথা উল্লেখ্য করেছেন- ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং আমরা কোথায় যাচ্ছি’? কিন্তু আমার মনে হয় এই দুইটি মৌলিক প্রশ্নের আগেও যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- ‘আমরা কেন এসেছি?’ পৃথিবী নামক সুন্দর গ্রহে আমরা কেন এসেছি? আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি? এই ‘অরিজিন’ ও ‘ডেস্টিনেশন’এর উত্তর খোঁজার থেকে এই ‘কেন’ প্রশ্নটাই আমাকে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করে। জাপানী একটা প্রবাদ আছে- ‘মানুষের জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার আগেই মানুষ তার অর্ধেক জীবন নষ্ট করে ফেলে’। আমি প্রতিমুহূর্তে চেষ্টা করছি সেই অর্থটা খুঁজে বের করতে, জীবন ফুরিয়ে যাবার আগেই। পথ থেকে পথে, দেশ থেকে দেশান্তরে। বান্দরবনের পাষাণের স্নেহ ধারা থেকে শুরু করে হিমালয়ের শুভ্র তুষারচূড়া, প্রতিটি পাথরের খাঁজে খাঁজে, প্রতিটি হিমবাহ গলে বয়ে চলা নীলাভ নির্ঝরিনীর বিন্দুতে আমি খুঁজে ফিরি মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র।

তারই সূত্র ধরে পাহাড়-পর্বত নিয়ে একসময় প্রচুর বকবক করতাম। পরিচিত, অর্ধপরিচিত মানুষজনের সাথে পাহাড় পর্বত নিয়ে জ্ঞান দেবার ও নেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারলাম এসব অরণ্যে রোদন। তাদের কাছে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার ‘শো-অফ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাও চেষ্টা করতাম। ঈশ্বর তো আর হাওয়ায় থাকে না; আমার কাছে ঈশ্বর যেমন একটা বিশ্বাস, তেমনি বিশ্বাস করতাম কয়েকজনের মধ্যে অন্তত পর্বতের দর্শনটা সৃষ্টি করতে পারবো। জাজমেন্টাল মানুষ তো থাকবেই৷ ওদেরও বিশ্বাস করাতে চাইতাম। বুঝাতে চাইতাম হিমালয়ের মত এতো বড়, এত নিরব রণক্ষেত্র পৃথিবীর আর কোথাও নেই, কোন কালে ছিলও না। সেই এই রণক্ষেত্র রক্তপাতের নয়। এই রণক্ষেত্র ধর্মবাদের, দর্শনমতের। রক্তপাত ঘটেনি ঠিকই কিন্তু যোগতন্ত্রায় আত্মসমাহিত কত তপস্বীর জীবনপাত ঘটে গেছে এই হিমায়লয়ের প্রতিটি গুহাজুড়ে। সত্যকে যারা অক্লান্তভাবে খুঁজেছে, আলোর সন্ধানে যারা দুর্গম পথে পাড়ি জমিয়েছে, জীবনের মানে খুঁজতে যারা দারুণের পথে অগ্রসর হয়েছে, তাদের চেয়ে রণবীর কেই বা আছে?

কিন্তু কি হলো? তাদের সবকিছু আটকে আছে সেই কয়েকটি ছবির মধ্যেই। একটা ছবি কি একটা অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারে? এই যেমন ধরুন এমন একটা ছবিটি কি কোন অর্থ প্রকাশ করতে পারে যেখানে কিছু খুচরো আগুন নিভু নিভু করে জ্বলছে, আর কিছুই না? কিন্তু আমি এই আগুনটুকুর জন্যই যে কতটক ছটফট করেছি, হাঁসফাঁস করেছি, কতটা শ্রম দিয়েছি সেই নিগুঢ় অভিব্যক্তি কি কোন ভাবে প্রকাশ করতে পারব? সারাদিন কিছু না খেয়ে, দুই দিনের ট্রেক একদিনে শেষ করে সন্ধ্যে নাগাদ বেজক্যাম্পে পৌঁছেছিলাম। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিলো। তাবু পিচ করেছি মাত্র। এরই মধ্যে তাপমাত্রা মাইনাস দশের নিচে নেমে গেছে। হাত পা ঠান্ডায় জমাট বেঁধে যাচ্ছে। তার উপর রাত চারটার দিকে সামিট পুশ। মনে হচ্ছিলো আগুনের একটা ফুলকি পেলেই ঢপ করে গিলে ফেলব। ভেবেছিলাম একটা স্টোভ ভাড়ায় পেয়ে যাবো। কিন্তু এই দুর্গমে ভাগ্য সবসময় সহায় হয় না। তার উপর তুষার জমে সবকিছু ভেজা স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। তখন প্রায় ২ ঘন্টা সেই অন্ধকারে একাকী এই আগুনটুকুই জ্বালিয়ে এক প্যাকেট নুডুলস আধসেদ্ধ করে খাওয়ার অনুভূতিটা কি কখনো ছবি দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব?

কাজের ফাঁকে বই পড়া আমার অভ্যাস। অফিসে কাজের ফাঁকে বই পড়ছিলাম একটা- ‘নাঙ্গা পর্বত পিলগ্রিমেজ’। হারম্যান বুলের লেখার অটোবায়োগ্রাফি বলা যেতে পারে। কি বই পড়ছি? ‘নাঙ্গা পর্বত’! মানে ন্যাংটা পর্বত! এ নিয়ে এখনও আমাকে নিয়ে প্রায়ই হাসাহাসি করা হয়- ‘কি সোয়াইব, নাঙ্গা পর্বত কবে যাচ্ছো?’, ‘তোমার নাঙ্গা পর্বতের কি খবর?’ এসব অট্টহাসির পাত্র হতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু হায়! এই মানুষগুলো যদি জানতো এই কিলার মাউন্টেনের ইতিহাস, বুঝতো এর দর্শন, উপলব্ধি করতে পারতো এর শিক্ষা! নাহ! এ সবই আমার মনের অলীক কল্পনা। আমি পুরোপুরি হতাশ। আজকাল আমার এসব নিয়ে কথা বলতেই বিরক্ত লাগে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে পাহাড়ে কেন যাও? সোজাসাপ্টা উত্তর দেই - ঘুরতে। এর বেশি আর কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। কয়েকটি সংগঠন থেকেও অনেকদিন ধরে বলছিলো পাহাড় নিয়ে কিছু প্রোগ্রামের আয়োজন করতে। কিন্তু আজকাল আমার মন আর টানেনা। পাহাড় নিয়ে কথা বলতে হবে শুনেই কেমন জানি গা গুলিয়ে ওঠে। শুধু মনে হয় এইবার এই প্রলাপ বন্ধ করি, বন্ধ করি এই কথার উন্মেল মৃতপ্রসূত বোধ। এসব আমাকে দিয়ে আর আসলেই হবে না। যার জীবনদর্শন তার কাছেই থাকুক। তার চেয়ে বরং তাদের মত গুহাবাসী হওয়াই উত্তম মনে করছি; তাদের প্রশ্নোত্তর মীমাংসার পথ ধরে আমিও হেটে মরি সত্যের জগতে, আলোক সন্ধানে।