সকল মানুষের জীবনই ঘটনাবহুল হয়, নাটকীয় হয়, বিস্ময়কর হয়, রহস্যময় হয়। কিন্তু এরই মাঝে কিছু কিছু মানুষের জীবন এতটাই ঘটনাবহুল ও নাটকীয় হয় যে তা সাধারন বাস্তবতাকেও হার মানায়। সেই নাটকীয়তা পরিবর্তন করে দেয় মানুষটার সমগ্র জীবন ধারা, সমস্ত সত্তাকে। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় পড়ে হয়ে ওঠেন অন্যতম। কিন্তু এমন মানুষ হাতে গোনা সামান্য ক’জনই জন্মগ্রহণ করেন। তেমনই একজন হলেন পোলিশ পর্বতারোহী ভান্ডা রাটকিভিকজ, যাকে পোলিশ পর্বতারোহন তথা সমগ্র পর্বতারোহন বিশ্বে ও নারী পর্বতারোহনের অন্যতম পথিকৃৎ মনে করা হয়। কিন্তু রাটকিভিকজ কখনও ভাবেননি তিনি পর্বতারোহনের জীবনে কখনো পদার্পন করবেন। একে একে জয় করতে থাকবেন বিশ্বের উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের অন্যতম খেলা পর্বতারোহণে পোল্যান্ডকে বিশ্বমঞ্চের যারা তুলে ধরেছিলেন তাদের মধ্যে ভান্ডা রাটকিভিকজ ছিলেন অন্যতম।

রাটকিভিকজের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী পোল্যান্ডের মাত্র সাড়ে এগারো কিলোমিটারের ছোট্ট, শান্ত শীতল শহর প্লুনগি, লেত্ভা-তে। তার জন্মক্ষণটাই ছিল এক অস্থিতিশীল সময়ে। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাঢোল। পোল্যান্ড তখন সাক্ষী হয় ইতিহাসের ভয়াবহ ও নির্মমতম সময়ের। নাৎসি জার্মান ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার বৈশ্বিক ক্ষমতার লোভে বলি হয় পোল্যান্ড। ৬ বছর দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে প্রায় নিঃশেষ ও ভঙ্গুর অর্থনীতির পোল্যান্ডের নিয়ন্ত্রন চলে যায় যুদ্ধজয়ী সোভিয়েন ইউনিয়নের কাছে। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধে উদ্ধারকৃত জার্মানীর রাজ্য পশ্চিম পোল্যান্ডের রোক্ল-এ তার পরিবার চলে যায়। তখন থেকে তার বেড়ে ওঠা শৈশব ও কৈশর কাটে এই শহরেই। সেখানকারই ‘রোক্ল ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি’থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ‘ইনস্টিটিউট অফ পাওয়ার সিস্টেম অটোমেশন’-এ তিনি তার চাকরী জীবন শুরু করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস-এ চলে আসেন এবং জীবিকা হিসেবে ‘ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথমেটিক্যাল মেশিন’-এ কাজ শুরু করেন।

তখন থেকেই তিনি ভলিবল খেলতেন। ভলিবলে তার প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। গাড্ডিয়া রক্লো-র আই-লিগ দলের হয়ে খেলতেন। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলেম্পিকের আগ পর্যন্ত তিনি এই অলেম্পিক দলের সদস্য ছিলেন। এক বছর পরে বুদাপেস্ট-এ ইউনিভার সিইডেও অংশগ্রহন করেন। এছাড়াও তার পছন্দের খেলাধুলার তালিকায় ছিল দৌড়, চাকতি ও ছোঁড়া নিক্ষেপ ও বাইক রেস। তখনও তিনি পর্বতারোহন নামক খেলার সাথে অপরিচিত। এমনই এক সময়ে হঠাৎ করেই তার পর্বতারোহনের সাথে পরিচয় ঘটে বেশ নাটকীয় ভাবে।

রাটকিভিকজ একজন পেশাদার মোটর বাইক আরোহী হিসেবে ইয়ুনাক বাইক চালাতেন যা ছিল তৎকালীন পোল্যান্ডের সবচেয়ে ভারী বাইক হিসেবে গণ্য করা হত। ১৯৬১ সালের গ্রীষ্মের এক সকালে তিনি তার প্রিয় ইয়ুনাক বাইক নিয়ে বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে তার বাইকের জ্বালানী শেষ হয়ে যায়। তিনি রাস্তার পাশে সাহায্যের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন তাকে সাহায্যের জন্য দুইজন এগিয়ে আসেন। তাদের মাঝে একজন ছিলেন বোগদান ইয়ানকস্কি। যিনি ছিলেন একজন পর্বতারোহী এবং ওই সময়ে তিনি সোকোলিকীতে পডোলানি পর্বত অভিযানে যাচ্ছিলেন। বোগদানের মুখে গল্প শুনে পর্বতারোহন বিষয়টা ঝাঁকিয়ে বসে রাটকিভিকজের মনে। তিনিও তাদের সাথে সেই অভিযানে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বোগদান ইয়ানকস্তি বলেন-

আমি একটি সাধারন পর্যটন ভ্রমনের কথা বলে ভান্ডাকে সরাতে চেয়েছিলাম। আমরা সোকোলিকীতে যাই এবং সুকিননিসের গ্রেট চিমনিতে ট্রাঙ্কের উপর ভান্ডাকে রেখে বলি- ‘আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমরা শীঘ্রই চলে আসবো।’ কিন্তু কিছুক্ষন পরে ক্লোথ হলের অন্য দিকে, গ্রেট চিমনিরর পেছনে, আমি কিছু লম্বা ঊর্ধ্বশ্বাস শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি জনকে বললাম- ‘দেখ জন, আমার মনে হয় ভান্ডা উপরে উঠছে’। জন আমাকে বলল- ‘তো তুমি কি করছ, বেকুব’? আমরা যখন উপরে পৌঁছাই তখন দেখি ভান্ডা মাটি থেকে প্রায় ২০ মিটার উপরে উঠে গিয়েছে তাও কোন দড়ি ছাড়াই। আমি ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম কারণ চিমনিটি ছিলো অনেক প্রশস্ত। তখন আমি ভান্ডার দিকে একটি দড়ি ছুড়ে দিয়ে বললাম এটা ধরে উপরে উঠে আসো। কিন্তু ভান্ডা সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে একাই আরোহন করে উপরে উঠে এলো। এটাই ছিলো তার প্রথম পর্বতারোহণ।


 

সোকোলিকীর ইয়ানো ভিসাভিয়ালকা গ্রামের যা পোলিশ ভাষায় ফেলকন পর্বত নামে পরিচিত সেই থেকে শুরু। এরপর পর্বতারোহণ তার জীবনের পুরোটা যায়গা দখল করে বসল। পর্বতারোহণের নেশায় বিভোর হয়ে পড়লেন। কিন্তু পোল্যান্ডের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা কোন ভাবেই পর্বতারোহণের জন্য উপযুক্ত ছিলো না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পোল্যান্ডে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র প্রচলিত। এই রাজনৈতিক মতবাদে রাষ্ট্রের জনগণের সমস্ত কিছুর ব্যাবস্থা করত রাষ্ট্র। জনগণের স্বাদ-আহ্লাদ বলে কিছু ছিলো না। তাই তখন পর্বতারোহণ পোল্যান্ডের জনগণের কাছে একটি ব্যয়বহুল বিলাসিতা মাত্র। তবুও তিনি রোক্ল হাই মাউন্টেন ক্লাবের সদস্য হন।

১৯৬২ সালে হালা গাসানিকোয়া থেকে তাতরা মাউন্টেন কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর থেকেই তাতরা মাউন্টেনের সাথে তার রোমাঞ্চকর পর্বতারোহন অভিযাত্রা শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে তিনি উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্বতে আরোহন শুরু করেন। তাতরা মাউন্টেনে থাকাকালীন সময়ে তিনি অনেক দুর্গম রুটে পদাচারণা করেন। যেমন- ওয়েইরিট, মিঙ্ক এর ‘ভ্যারিয়েন্ট আর’ যাকে তৎকালীন পর্বতারোহনে ক্লাসিক চূড়া বলে মনে করা হত। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর আন্দ্রেজ উজানস্কির সাথে উত্তর-পশ্চিম এর নতুন রুট দিয়ে নাজিয়ানিয়া উইসোকা গেরালচোয়েস্কা, ১৯৭৩ সালে মাউন্ট কেজমার্স্কি সজেকিট-এর নর্থ ফেস, শীতকালে ফ্রানজুককে সাথে নিয়ে মিঙ্ক এর দ্রোগা ফিরেনস্কি আরোহন করেন।

তাতরা মাউন্টেনের পর তিনি আল্পস পর্বতমালার দিকে অগ্রসর হন। ১৯৬৪ সালে তিনি ওভো গ্রুপ নামের একটি তরুণ দলের দলনেতা হিসেবে জিল্লার্টাল আল্পসে প্রথম পা রাখেন। এরপর হেলমুট শেরফেট্টার পরিচালনায় উদ্ধারকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন এবং পরবর্তীতে হেলমুটকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করেন। সেই বারের অভিযানে হওফফেনারসপিতজের উত্তর-পশ্চিম দেয়াল, জেডজিস্লর সাথে ওলপারার ফ্ল্যাঙ্ক-এর উত্তর পশ্চিম দেয়াল অতিক্রম করেন।

পরের বছর তিনি ডোলোমাইটস যান এবং সেখানে টার্নিয়া ভ্যাজেললেট ও টর স্ট্যালেলারের মধ্য দিয়ে ফারম্যান রুট অতিক্রম করেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে ইউরোপের ছাদ নামে পরিচিত ৪৮১০ মিটারের মাউন্ট ব্লাঙ্ক আরোহনের মাধ্যমে উচ্চতাপ্রীতিকে আরও একধাপ অগ্রসর করে নেন। একই বছরে প্রথম নারী দল হিসেবে হালিনা ক্রুজার সিরোকোমমস্কাকে সাথে নিয়ে নিডল অফ গ্রিপনের পূর্ব ফেস আরোহন করেন। কিন্তু কোন কিছুই যেন তার উচ্চতার ক্ষুধাকে নিবৃত করতে পারছিল না। পরের বছর তিনি নরওয়ে আসেন এবং মাত্র তিনদিনে হালিনা ক্রুজার সিরোকোমমস্কাকে সাথে নিয়ে ইস্টার্ন পিলার অফ টলরিগজেন আরোহন করেন। এটা ছিল প্রথম কোন নারীদলের অভিযান।

কয়েক বছর পরে তিনি আবার আল্পসে ফিসে আসেন এবং ১৯৭৩ সালে মেসনার ও হাইএবেলেরা রুট ধরে, দানুয়া গ্লেনার-ওয়াচ, স্টিফানিয়া ইজিয়ার্সডর্ফকে নিয়ে নর্থ পিলার অফ এইগার আরোহনে সমর্থ হন। এটিও ছিল প্রথম নারী ও দ্বিতীয় সফল অভিযান। যদিও তার অভূতপূর্ব সাফল্য ছিল ১৯৭৮ সালের ম্যাটারহর্নের শীতকালীন অভিযান। এটা সত্যি যে সে বারে একমাত্র ক্রিস্টিনা পলব্লসকা ম্যাটারহর্ন-এ পৌঁছাতে পেরেছিলেন। আন্না কের্ভুইনস্কা ও রাটকিভিকজ চূঁড়োর ৭০ মিটার নিচে অসুস্থ ইরিনা কিসার সেবা করার জন্য থেকে যান এবং উদ্ধারকর্মীদের জন্য অপেক্ষা করেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন-

কারণ বাস্তবিক অর্থে- পর্বতে কেউ কাউকে সহযোগীতা করতে পারে না। (পর্বতে) কেউ কাউকে পিছনে পিছনে টেনে নিতে পারবে না এবং তার নিখুঁত সহযোদ্ধা হিসেবে দাঁড়াতেও পারবে না। সে শুধু পারে অন্যের লক্ষ্যকে নিজের শক্তি, উৎসাহ ও কাজের দ্বারা সচল করতে।

১৯৭১ সালে বাভারিয়ান রুট নর্থ ফেস দিয়ে ট্রিগ্লাভ ও ১৯৭৯ সালের ১৫-১৬ জুলাই সেই ইরিনা কিসাকে নিয়েই বোনাটী রুট পূর্ব ফেস ধরে গ্রান্ড ক্যাপিউসিনে পা রাখেন। পরবর্তী দুই দশক ধরে তিনি নারী পর্বতারোহনে অতুলনীয় নজির সৃষ্টি করেন। পর্বতারোহনের কৌশল ও দর্শনের উন্নতি সাধনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। একের পর এক অভিযানের সম্পর্কে ভান্ডা বলেন-

আমি সেখানে কখনই একাকী বোধ করি না। আমার মনে হয় একজন মানুষ মানুষের মাঝেই বেশি একাকী বোধ করে। আমি যা আমার জন্য বেছে নিয়েছি তার কিছুই খারাপ নয়। আমি একাকীত্ব উপভোগ করি এবং এই একাকীত্বই মানুষের কাছে ফিরে আসুক।

১৯৭০ সালে তৎকালীন সহকারী স্বাস্থ্য সচিব জন রাটকিভিকজ এর ছেলে, ওয়ারসের পর্বতারোহী ওয়জেচি রাটকিভিকজকে তিনি বিয়ে করেন। তাদের বিয়ে মাত্র কয়েকমাস স্থায়ী হয়েছিল কিন্তু তিনি তার রাটকিভিকজ নামটি তখন থেকেই স্থায়ীভাবে রেখে দেন।

এরপরেই তার সর্বোচ্চ খ্যাতি ধরা দিতে থাকে উচ্চ পর্বতগুলো আরোহন করার মাধ্যমে। ৭০০০ মিটারের অধিক উচ্চ পর্বত অভিযানে তিনি প্রথম অংশগ্রহন করেন ১৯৭০ সালে। আন্দ্রেজ উজানস্কির নেতৃত্বে সে বছর পামিরের ৭১৩৪ মিটার উচ্চতার লেনিন পিক অভিযানে যোগ দেন। এরই দুই বছর পরে ১৯৭২ সালের ২৩ শে আগস্ট পর্বতারোহণের জগতে আরেক লড়াকু পর্বতারোহী জার্জি কুকোজকার নেতৃত্বে প্রথম পোলিশ নারী পর্বতারোহী হিসেবে হিন্দুকুশের নজাক পর্বত আরোহনের মাধ্যমে প্রথম হিমালয়ে পদার্পন করেন। এছাড়া একই বছর ১৪ ও ১৫ আগস্ট ডাব্লিউ ৮২ (৫৯৬০ মি) ও ডাব্লিউ ৮১ (৫৯৮০ মিটার) নাম না জানা পর্বত আরোহন করেন।

১৯৭৫ সালে তিনি প্রথম কারাকোরাম অভিযান করেন। সে অভিযানে তিনি অ্যালিসন চ্যাডউইক-ওনিজকুইয়েজ, জনস অ্যানিসক্কুইয়েজ এর সাথে ১১ই আগস্ট তৎকালীন সময়ের সর্বোচ্চ ভার্জিন পিক গাশারব্রুম ৩ আরোহন করেন। এটিই ছিল পোলিশ নারী পর্বতারোহীদের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার রেকর্ড। পরের দিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১২ই আগস্ট অ্যালিসন চ্যাডউইক-ওনিজকুইয়েজ কে নিয়ে গাশারব্রুম ২ আরোহন করেন। ১৯৮৫ সালে সাউথ ফেস ধরে ওয়ান্ডা রুটকিভিচ, স্টেফেন শ্যাফটার এর সাথে অ্যাল্পাইন পদ্ধতিতে অ্যাংকারাগুয়া ও ওয়েন্দা রটকিভিচ, মনিকা নাইডবালস্কা, আইভোনা গ্রোনকিভিচ-মার্সিস, ইওয়া সজিশিয়ানিক, ইওয়া পাঞ্জেকো-পাঙ্কুইয়েজের সাথে ১৯৮৮ সালে সেরো টেরে আরোহন করেন।

এরপর ১৯৭৮ সালে তিনি পশ্চিম জার্মানির এভারেস্ট অভিযানে অংশগ্রহন করেন। ১৬ অক্টোবর ইতিহাসের তৃতীয় এবং ইউরোপের প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্টের চূঁড়োয় পা রাখেন। সেই একই দিনে করোল ওয়াজাল্লা ভ্যাটিকানের ‘জন পল ২’ এর পোপ নির্বাচিত হন। তখন তিনি তার উদ্দেশ্যে বলেন-

ঈশ্বরের অপার করুনা যে আমরা একই দিনে এত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলাম

তৎকালীন সময়ে পোল্যান্ডের জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয় এক অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যাবস্থা। এই শাসন ব্যবস্থায় সমস্ত সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র। জনগণের সকল মৌলিক চাহিদা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান, এমনকি খাদ্যও রাষ্ট্র কর্তৃক বন্টন করে দেয়া হতো। এমন পরিস্থিতিতে স্বাধীন দেশে হয়েও জনগণের নিজস্ব ইচ্ছা বলতে আলাদা কিছু রইলো না। তখন তার পক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবেই একটি প্রোপাগান্ডা ছড়ায়- পোলিশ জনসংখ্যার বিব্রতকর অবস্থার জন্য দায়ী কতৃপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য জাতীয় সংবাদপত্র তাকে নেতৃস্থানীয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

১৯৮১ সালের ১৭ মার্চ মাউন্ট এলব্রুস অভিযানকালে চরম দুর্ঘটনায় তার পর্বতারোহণ জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। তার বাম হাতে ফাটল ধরে। ফরে দীর্ঘদিন তাকে পর্বতারোহণ থেকে দূরে থাকতে হয়। কিন্তু কিন্তু দমে যাননি, ফিরে এসেছেন-

আমি পর্বতে আমার অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। কিন্তু মানুষ কখনোই পর্বতারোহনের মত আশক্তিকে ছেড়ে দিতে পারে না। এমন কি যখন সে মৃত্যুর সাথে খেলছে। জীবনের আস্বাদন তখনই পরিপূর্ণতা পায় যখন তুমি তাদের হারিয়ে ফেল।

এরপরের কোন আটহাজারী পর্বতের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সাত বছর। অতঃপর ১৯৮৫ সালের ১৫ জুলাই ডায়ামির ফেস দিয়ে নাঙ্গা পর্বতের চূঁড়োয় পৌঁছান এবং সেই থেকেই তার ‘ক্যারাভান টু ড্রিম’ শুরু হয়। এই ক্যারাভান টু ড্রিমের মূল লক্ষ্য ছিল সকল আটহাজারী পর্বত আরোহন করা। কিন্তু ভাগ্য সবসময় তার পক্ষে ছিল না। তৃতীয় আটহাজারী পর্বত ও তার আরোহনের চেষ্টা করা নবম পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘায় তার জীবনাবসান ঘটে।


১৯৮৫ সালে নাঙ্গাপর্বত আরোহনের মাধ্যমে রাটকিভিকজ সে ক্যারাভান অফ ড্রিম শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ১৯৮৬ সালের ২৩ জুন প্রথম নারী হিসেবে স্যাভেজ মাউন্টেন বা হিংস্র পর্বত খ্যাত কে-২ আরোহন করেন, তাও কোন রকম সম্পূরক অক্সিজেন ছাড়াই। তার পর্বতারোহণ জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে এটিকেই গনণা করা হয়। কারণ এই অভিযানে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ফ্রান্সের এক শখের পর্বতারোহী দম্পতি লিনিয়ান এবং মাউরিক বার্রার্ড এর সাথে। কে-২ থেকে নামার পথে তারা উভয়েই নিহত হন। এমনকি সেই মৌসুমে কে-২ অভিযাত্রীদের দুই-তৃতীয়াংশই মারা যায়।

ভাগ্যের সহায়তা, নিজের অপরিমেয় ক্ষমতা ও কৌশলের সমন্বয়ে রাটকিভিকজ এর ক্যারাভান টু ড্রিম দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তিনি বুড়িয়ে আসছেন। আর বেশিদিন পর্বতারোহণ করতে পারবেন না। তাই এমনও হয়েছে একই মৌসুমে তিনি দুইটি আটহাজার মিটারের পর্বত আরোহন করেছেন। কতটা আবেশ, ঘোর আর পর্বতের প্রতি আচ্ছন্ন থাকলে এমন করা সম্ভব! তারই ধারাবাহিকতা ১৯৮৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রিশার্ড ওয়ার্কি, কার্লোস কার্সোলিও, এলসা আভিলা, রামরি নাভেররের সঙ্গে শিশাপাংমা আরোহন করেন। চূঁড়োর কাছাকাছি পৌঁছে তাদের সাথে যোগ দেন জার্জি কুকোজকা ও আর্টুর হজর। তারা তখন নতুন পথে অ্যাল্পাইন পদ্ধতিতে উঠেছিলেন। এরপর ১৯৮৯ সালের ১২ জুলাই গাশারব্রুম ২, ১৯৯০ সালের ১৬ জুলাই ইভা প্যানকুইয়েজের সাথে গাশারব্রুম ১, ১৯৯১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর একাকী চো ইয়ো, একই বছরের ২২ নভেম্বর একাকী সাউথ ফেস ধরে অন্নপূর্ণা ১ আরোহন করেন। তিনি বলেছিলেন-

এমন অনেক নারীই আছেন যারা আমার থেকে অনেক ভালো আরোহন করতে পারেন। যদিও আমি মনে করি পর্বতের জন্য আমার আরও নানাবিধ বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক।

কিন্তু তার ক্যারাভান টু ড্রিম অসমাপ্ত রেখেই ১৯৯২ সালের ১৩ মে (মতান্তরে ১৩ মে) কাঞ্চনজঙ্ঘায় তার জীবনাবসান হয়। ১৯৯২ সালে নিজের ব্যক্তিগত নবম আটহাজারী পর্বত ও বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে বের হন। ৪৯ বছর বয়েসী রাটকিভিকজের সেই অভিযানে সর্বশেষ তাকে জীবিত দেখেন তার সহ-অভিযাত্রী ম্যাক্সিকান পর্বতারোহী কার্লোস কার্সোলিও। তারা ১২ মে ৭৯৫০ মিটারের ক্যাম্প-৪ থেকে ভোর ৩:৩০ এ সামিট পুশ দেন। কয়েকঘন্টা ঘন তুষারের মাঝে আরোহন করে কার্লোস চূঁড়োড় পৌঁছান। নামার পথে ৮৩০০-৮৪০০ মিটারের কাছাকাছি কার্লোসের সাথে রাটকিভিকজের সর্বশেষ দেখা হয়। রাটকিভিকজ তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল সামিট থেকে ৩০০ মিটার নিচে। নর্থ-ওয়েস্ট ফেস দিয়ে আরোহনের সময় সে রাতের মত বিভুয়াক (তাবু ফেলা যায় না এমন যায়গায় কোন রকমে অস্থায়ী ক্যাম্প) করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তার কাছে তখন খাদ্য, রান্না করার কোন সরাঞ্জাম কিংবা বিভুয়াক করার মতও কিছুই ছিলো। সে সময়ে তিনি প্রচন্ড দুর্বল ও অসুস্থ ছিলেন যে কারণে তিনি নেমেও আসতে পারছিলেন না। কার্সোল বলেন তার নিজেরও তখন রাটকিভিকজকে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়ার উপায় ছিল না। কারণ সে সময়ে তিনিও ছিলেন প্রচন্ডভাবে দুর্বল। এরপরে এই লড়াকু সাহসী রাটকিভিকজকে আর কখনো দেখা যায় নি। তারই মুখের বাণী-‘আই উইল ডাই অন মাউন্টেন কে সত্যি করে দিয়ে কালের অতলে  চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন এই তুষার মানবী।

তবে মনে করা হয় ১৯৯৫ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাউথ-ওয়েস্ট ফেসে ফুয়াস্তো দ্য স্তেফানি, মার্কো গালেজ্জি ও সিলভিও মনডিনেল্লি তার মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তারা ধারণা করেন রুতভেকিজ নর্থ-এয়েস্ট রিজ লাইন ধরে প্রায় সামিটের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন এবং তখনই সাউথ-ওয়েস্ট রিজে তার পতন ঘটে। কিন্তু এই তথ্যের বিশদ বিশ্লেষন করে, কাপড়ের রং ও সাথে বুলগেরিয়ান ওষুধের প্যাকেট দেখে ইতালীয়ান পর্বতারোহী ধারণা করেন যে ওই দেহটি আসলে বুলগেরিয়ান পর্বতারোহী জুর্দানকা দিমিত্রোভার। যিনি ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ পশ্চিম রিজ ধরে ওঠার সময় তুষার ধ্বংসের কারণে মারা যান। তাই বলা যাচ্ছে না যে ওটা রাটকিভিকজই ছিলেন কিনা এবং রাটকিভিকজ আদৌ কাঞ্চনজঙ্ঘা সামিট করেছেন কিনা। যদি করে থাকেন তবে তিনিই প্রথম নারী যিনি বিশ্বের সবচেয়ে উচু তিন পর্বতে প্রথম পা রাখেন। তার মৃত দেহ আজও পাওয়া যায়নি।

তার মৃত্যুতে পর্বতারোহন সমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে। পর্বতারোহনের বিভিন্ন প্রধান প্রধান সাময়িকীতে তার সম্পর্কে বিভিন্ন পর্বতারোহীরা স্মৃতিচারণ করেন। রেইনহোল্ড মেসনার তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন-

রাটকিভিকজ তার কাজের দ্বারা মুক্তির কথা প্রকাশ করে গিয়েছেন। তার সম্পর্কে এখন আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কারণ ভান্ডার অর্জনের কোন যুক্তি-তর্ক হয় না, হয় শুধুমাত্র প্রমাণ।

তিনি লেখক ও সহ-লেখক হিসেবে বেশ কিছু বই লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য- গেটিং গাশারব্রুম, অন ওয়ান লাইন, ক্যারাভান অফ ড্রিমস, এভরিথিং এবাউট ভান্ডা রাটকিভিকজ, নাঙ্গা পর্বত'৮৫, ওমেন অফ দ্য স্নো, মোর অন ভান্ডা রাটকিভিকজ। ২০১২ সালের ৫ মে ওস্তেস্তার কাছাকাছি তার ও জর্জ কুকোজকার পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে ফলক স্থাপন করা হয়।


তথ্যসূত্রঃ

[১] wikipedia.org

[২] winterclimb.com

[৩] drytooling.com.pl

[৪] exploreaudree.com

[৫] everesthistory.com

[৬] Freedom Climbers by Bernadette McDonald

[৭] Savage Summit: The Life and Death of the First Women of K2 by Jennifer Jordan