রাত্রি দ্বিপ্রহর। যান্ত্রিক এই নগরের অধিকাংশ মানুষ সারাদিন বসন্ত উৎসবের আমেজে মেতে ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে। রাস্তার সোডিয়াম বাতির মৃদু আলোতে দু’ একটা কুকুর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। মৃত্যুর মত নীরবতা। ঠিক তখনই প্রিয় মানুষটা আইসিইউ-তে, লাইফ সাপোর্টে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পরিবারের সকল সদস্যরা। কমবেশি সবাই বৃদ্ধের স্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। বয়সতো আর কম হলো না! কিন্তু তখনও শিয়রে বসে থাকা বৃদ্ধা স্ত্রী হার্টবিটটা কখন থেমে যায়, স্ক্রিনে মিটিমিটি করে লাফাতে থাকা লাইনটা কখন সরল রেখায় পরিণত হয় সেই আতংকে চোখ মুছছেন বারংবার। বৃদ্ধ স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যুটাও যেন আরেকটু দীর্ঘায়িত হয় তার প্রার্থনা করে যাচ্ছেন প্রতি নিঃশ্বাসে।

এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বিয়েটাও হয়তো হয়ছিল কেউ কাউকে না দেখেই, বাবা-মায়ের পছন্দেই। কিন্তু সেই অপরিচিত প্রণয়েও ভালবাসা জন্মাতে সময় নেয়নি মোটেও। তারা জানেন ভালোবাসা মোটেই জন্মাবার জিনিস নয়। ভালোবাসা হচ্ছে পাত্র থেকে উবে যাওয়া কর্পুরের মতো, যা হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠ থেকে নিঃসারিত হয়ে মিশে যায় শূন্যে, নীলকাশে। ভালোবাসা মানে বুকের ভেতর কেমন জানি একটা আনন্দ, অন্যদিকে স্তব্ধ এক কান্না।

এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভালবাসা দিবস বোঝেন না। বিয়ের পরে যৌবনের প্রথম দিকটা সারাদিন অনেক ব্যস্ততায় কাটত তাদেরও। ভুলে যেতেন গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে পরস্পরের শুভেচ্ছা জানাতে। তবুও ভালোবাসাটুকু মরে যায়নি কখনোই। দীর্ঘ জীবনে অনেকে ছেড়ে গিয়েছে, অনেককে ছেড়ে এসেছেন, শুধু ছাড়তে পারেননি দু’জন দু’জনকে। ক্ষাণিক বাদেই একজনে ছাড়তে হবে সেটাও বোধহয় বৃদ্ধা জানেন। তবুও অপেক্ষা; অপেক্ষা তেমনটি, যেমনটি করতেন প্রতিদিন সন্ধ্যায় দরজায় দাঁড়িয়ে, যেমনটি করতেন প্রতিদিন অফিসে যাবার আগে টাইটা গলায় বেঁধে দিয়ে। বাসর রাতের সেই স্মিতহাস্যমিশ্রিত মুখখানা থেকে শুরু করে অক্সিজেন মাস্ক পড়া এই নিথর-নিশ্চল মুখাবয়বের ছবিগুলো সব যেন বৃদ্ধার চোখের সামনে একে একে ঝলকে উঠছে।

তবে প্রেম কি এই? কই কখনো মুখ ফুটে বলা তো হয়ে ওঠেনি ‘ভালোবাসি’? ভালোবাসা মানে ’ ভালোবাসি’ বলার অধিকার নয়, বিশেষ দিনগুলোতে হুড তুলে রিক্সায় ঘোরাঘুরিতেই ভালোবাসার পরিব্যাপ্তি আবদ্ধ নয়। তাই যদি হতো তবে বুড়ো বয়সে ‘ওগো শুনছো টুনটুনির দাদু’ বলে ডাকাটা কি শুধুই অভ্যাস? জলের জন্য যেমন সমুদ্র আছে, তুষারের জন্য হিমাচল, তেমনি ভালোবাসার জন্যও রয়েছে আলাদা জগৎ। সেই জগতে গিয়ে প্রতিটি ভালোবাসা জমা হয়, জড়ো হয়, মানুষের আত্মা যেমনটি, রুহু যেমনটি।

ভালোবাসাগুলো যে সবসময় দু’টি আত্মার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এমনটাও তো নয়। বরঞ্চ একপাক্ষিক ভালোবাসাটাই সবচেয়ে নির্ঝঞ্জাট ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় ভালবাসার মানুষটিকে না পাওয়ার কোন ভয় নেই। বরং ভালো লাগার সাথে সাথেই তাকে ভালোবাসা হিসেবে পাওয়া যায়। তাকে চোখে চোখে রাখা আর ভালোবেসে যত্ন করা যায়।একলা ঘরে বসে-শুয়ে তাকে নিয়ে ভাবা যায়, আলাপ করা যায়, স্বপ্ন দেখা যায়। বৃষ্টি এলে এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়া যায়। তাকে দেখলেই নিজের মত করে বলা যায়, ঐ যে আমি ওকে ভালোবাসি। ‘ও’ শুনলো কিনা তাতে আমার বিন্দুমাত্র যায় আসেনা। আমি জানি আমি ওকে ভালোবাসি, এইতো বেশি। নিজের সুবিধামত কখনো বেশি ভালোবাসা যায়, আবার কখনো অল্পও ভালোবাসা যায়। এতে ও কখনোই এসে বলবেনা, কমবেশি হল কেন?

এইসব ভালোবাসা-বাসি কখনোবা স্বপ্নচারী মেঘের মত, যে মেঘ প্রতিনিয়ত আর্তনাদ করে কোন পলাতক নক্ষত্রের তরে। এই ভালোবাসা কখনো ষষ্ঠদশী উদাসীন বালিকার বিনিদ্র প্রহরে জোনাকির কাছে প্রলাপ; অনিদ্রায় কাতর, অপেক্ষমান পিপাসিত বৃষ্টি। সরীসৃপের মত বিবর্ণ হিমঝরা সেই রাতে বাদুড় আর পেঁচার গন্ধ যা বিমূঢ় আত্মার গভীরে জমাট বেঁধে থাকে নীলাভ ভালোবাসার দিকে চেয়ে। এই ভালোবাসার শুদ্ধতম অনুভূতি ছড়িয়ে যাক জন্ম থেকে জন্মান্তরে, কাল থেকে মহাকালে। স্নিগ্ধ সকালের ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো মিশে থাক ভালোবাসাগুলো।