‘মা দুর্গাকে সমগ্র নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। দুর্গা তো পার্বতীরই একটি রূপ। মা দুর্গার পুজাতেও পতিতার ঘরের মাটি লাগে। দুর্গাপুজায় অষ্ট কন্যার ঘরের মাটি নেয়ার পর নবম কন্যা হিসেবে পতিতার ঘরের মাটি নিতে হয়। এই নবকন্যা হল নাপিতানি, নর্তকী, শূদ্রাণী, মালিনী, কাপালিক, ধোপানী, ব্রাহ্মণী, গোয়ালিনী ও পতিতা। আমাদের ধর্মে মনে করা হয় পুরুষ হল পুণ্যের আধার। আর সেই পুরুষই যখন কোন পতিতার ঘরে যায় তখন সে তার জীবনের সমস্ত পূণ্য পতিতার ঘরের মাটিতে ধুলিসাৎ হয়ে যায়। বিনিময়ে সেখান থেকে সে নিয়ে আসে পাপ। আর এমন বহু পুরুষের পূণ্য পতিতার ঘরের মাটিতে মিশে সে মাটিকে করে তোলে পবিত্র। তাইতো দুর্গাপুজায় পতিতার ঘরের মাটি প্রয়োজন হয়। তাছাড়া পুরাণে আছে পতিতের শক্তি দেব দেবতাদের থেকেও বেশি। ঋষি বিশ্বামিত্র যখন ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন, তখন তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র মেনকাকে পাঠান। মেনকার নৃত্যের ফলে বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হয়। ফলে দেবরাজ ইন্দ্র সর্বশক্তিমান হয়েও যা পারলেন না, মেনকা তা হেলায় করে ফেলল।’

বুঝো তবে আমাদের শক্তি! এই বলে পার্বতী হি হি করে হাসতে লাগলো। হাসলে বড্ড সুন্দর লাগে ওকে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোতে অধরের দু’ধারে টোল সেই সৌন্দর্যকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুনে।

পার্বতীর সাথে আমার পরিচয় প্রায় বছরখানেক আগে। শীত তখন শেষের পথে। মাঘের সন্যাসী তার চাদর গায়ে জড়িয়ে যাই যাই করছে। টিএসসি বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিন্তু মন যেন বিষিয়ে আছে। সবকিছুতেই কেমন যেন এক নিঃসঙ্গতা, এক অস্বস্তি। তাই আড্ডার আসর ছেড়ে বাসার পথ ধরেছি। আমি থাকি সিদ্ধেশ্বরী। শাহবাগ বাসে জ্যামে বসে থাকার চেয়ে রমনার ভেতর দিয়ে পথ সংক্ষেপ করে চলে আসতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি সবসময়। রমনার পাশের ফুটপাত ধরে এলোমেলো ভাবে হাটছি। রাত খুব বেশি হয়নি। তবুও কুয়াশার পাতলা চাদরে চারপাশ গুমট হয়ে আছে। চারিদিকে শুনসান নিরবতা। শুধু পাশ দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটে যাচ্ছে বাসগুলো। মৎসভবন পেড়িয়ে কাকরাইলের দিকের পথ ধরেছি। হঠাৎ কে যেন বাঁ হাতটা টেনে ধরলো। ভয়ে শিউরে উঠতেই এক বৃদ্ধ কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “ছার মাইয়াডা লইয়া যান। আইজ দুইদিন ধইরা কিস্যু খায় নায়। বড়ই সুন্দার মাইয়া। রাইতে দুই প্লেড ভাত খাওয়াইলেই অইবো।”

ঘটনার আকষ্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এতোক্ষনে চোখে পড়ল বৃদ্ধাটি বাঁহাতে একটি কিশোরীর বাহু ধরে আছে। পরনে শীর্ণ জামা, চুলগুলো এলোমেলো বিক্ষিপ্ত, অজানা আশঙ্কায় চোখদুটো নিষ্প্রভ, রাস্তার সোডিয়াম আলোতে মেটে রঙের মলিন মুখখানা দেখেই বলে দেয়া যায় হয়ত আসলেই গত দু একদিনে কিছু মুখে রোচেনি। মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। বৃদ্ধা মলিন মুখে বলল, ‘দশ টেহায় কি অয় ছার? আপনে মাইয়াডা নিয়া যান।’ এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছে না। এই শহরে ধান্ধাবাজ মানুষের তো আর অভাব নেই। কিন্তু চোখদুটো মেয়েটির মায়াময় মুখেই বিদ্ধ হয়ে আছে। কি পবিত্র, করুণ নয়ন! বললাম, ‘আচ্ছা আসুন আমার সাথে। এখানে তো কোন দোকান দেখছি না, সামনে থেকে কিছু কিনে দেব।’

কাকরাইল মসজিদের সামনে কিছু বাদাম, আর ঝালমুড়ির দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। দুই দিনের উপোসী মুখে কি আর বাদাম রুচে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম ‘কি খাবে?’ কোন কথা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ধমক দিলাম এবার। মেয়ের চোখ চোখ বেয়ে দেখি টপটপ করে পানি পড়ছে। কোনমতে বলল, “ভাত খাবো।” পরিষ্কার, শুদ্ধ উচ্চারণ। মায়া সংক্রামক। মায়াকে মায়া করলে মায়া বাড়তেই থাকে। এই মেয়েটির জন্যও এখন আমার প্রচন্ড রকমের মায়া হচ্ছে। একটা রিক্সা ঠিক করে উঠে বসলাম মগবাজারের দিকে।

সে রাতে মগবাজারে ‘থ্রি স্টার রেস্টুরেন্ট’এ খেয়ে পার্বতীকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। যদিও সে বলছিল একাই যেতে পারবে কিন্তু অভয় হয়নি। ততক্ষনে বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে পার্বতী। সে যেন বিশ্বাসই করতে করতে পারছে না এই শহরে তার নারীত্ব ভোগ না করেই তাকে খেতে দিলো। খেতে খেতে বারবার বলছিল, “কোন হোটেলে নিয়ে যাবেন? বাসায় যাবোনা কিন্তু। আমার ভয় লাগে। দয়া করে পশুর মত কিছু করবেন না। আমারও ব্যথার অনুভূতি আছে।” তখন আমার টলটলে চোখ দেখেই বোধহয় সে আস্বস্ত হয়েছে।

নয়াটোলার এক ছোট ঝুপড়িতে সে আর সেই বৃদ্ধা থাকে। পড়াশুনা করত রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার পঁচামাড়িয়া ডিগ্রী কলেজে। কিন্তু পরীক্ষা আর তার দেয়া হয়নি। এক বছরের মধ্যেই জীবনটা পুরোপুরি বদলে গেল। বাবা মারা গেল, বড় বোনের স্বামী বোনের ক্যান্সারের জন্য বাপের বাড়িতে ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেল। বাবার শোকে মা ও অসুস্থ হয়ে পড়ল। ছোট ভাইটা ক্লাস ফাইভে পড়ে। সংসাসের সকল ভার একত্রে এসে জুটল পার্বতীর ঘাড়ে। সেই ভারের বোঝা লাঘব করতে গ্রামের নৃপেন কাকা রাজশাহী থেকে বায়িং হাউজে চাকরী দেবার নাম করে এনে বিক্রি করে দিয়ে গেল পতিতা পল্লীতে। সেখানেই এই বৃদ্ধার সাথে পরিচয়। পালিয়ে এল। কিন্তু জীবন তার পিছু ছাড়ল না। তাই সংসারের তাগিদে, পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে এই করেই প্রতিমাসে টাকা পাঠাচ্ছে বাড়িতে। এসব কথা পার্বতীর মুখে যখন শুনছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, এমনও হয়! সিনেমার গল্প যেন আমি চোখের সামনে বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি।

এরপর থেকে প্রায়ই দেখা হয় পার্বতীর সাথে। বই পড়তে বড় ভালোবাসে। তাই প্রতিমাসে একটা করে বই নিয়ে হাজির হই তার নয়াটোলার ঝুপড়িতে। সারা মাসের জমে থাকা গল্প শুনি। খুব মিষ্টি করে কথা বলে ও। গুছিয়ে গল্পও বলতে পারে। সেই গল্পের লোভই আমাকে হয়ত টানে। এই পার্বতীকে যত দেখি ততই অবাক হই আমি। একাই নুয়ে পড়া সংসারটাকে টেনে নিয়ে চলেছে। ওকে আমি কখনো পতিতা বলে ভাবতে পারি না। একদিন পার্বতীই বলল, ‘আমি তো পতিতা-ই। ‘পতি’ মানে যদি সংসারের কর্তা হয়, তবে ‘পতিতা’ মানে তো সংসারের ‘কর্ত্রী’। আমি তো আমাদের সংসাদের কর্ত্রীই। আর একদিন শুনি রিক্সায় বসে বিড়বিড়ড় করছে -

“স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী পুত্র হল মহাবীর দ্রোন, কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ণ দ্বেপায়ন, কানীন পুত্র কর্ণ হইল দানবীর মহারথী, স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেবে পেলেন পতি”

যেসব মেয়েরা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে দেহ বিক্রি করে সমাজ তাঁদের বলে পতিতা । অপরদিকে, যেসব মেয়েরা হাজার টাকার বিনিময়ে লুকিয়ে দেহ বিক্রি করে সমাজ তাদের বলে সোসাইটি গার্ল । যারা আর একটু বেশী দামে দেহ বিক্রি করে সমাজ তাদের বলে পার্টি গার্ল। এটাই আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র। এটাই এই লাল নীল আলোয় ভরা নগরের অন্ধকারের গল্প। এই নাগরিক জীবনর মাঝে মাঝে ‘প্রেরণা’ শব্দটির দিকে আড়চোখে তাকাই। প্রেরণা তো পাই এই পার্বতীর চোখে। নিজের জীবনকে অন্ধকার বিদিশায় নিমজ্জিত করে আজও স্বপ্ন বুনছে। স্বপ্ন বুনছে মায়ের চিকিৎসার, ছোট ভাইয়ের উচ্চশিক্ষার। অথচ নিজের কথা জিজ্ঞেস করলেই হাসতে থাকে। এই হাসির মাঝে মাছির পাখার মত কাঁপতে থাকা অধর যুগলের সম্মিলিত সম্বন্ধ-শৃঙ্খল থেকেই যেন আমার সমস্ত প্রেরণার সৃষ্টি। শুচিস্মিতা পার্বতী আমাকে টেনে নিয়ে যায় তার অজানা সম্মোহনী টানে। যথার্থ নাম ওর- ‘পার্বতী’। যেন হিমালয়ের বিশালতা বুকে ধারণ করে বসে আছে হিমালয়ের কন্যা পার্বতী। ও-ই তো শৈলজা, অদ্রিজা, নগজা, হৈমবতী, গিরিজা। কি আশ্চার্য সঞ্জীবনী শক্তি, কি অপরূপ মায়াময়তা।

আমি অসাধারন কেউ নই। সমাজ সংস্কারকও নই, অতি নগণ্য একটা মানুষ। এই ছোট্ট জীবনে অনেক নারী সংস্পর্শ পেয়েছি।  কাউকে প্রেয়সীরূপে, কাউকে বন্ধু, সহপাঠী রূপে। তাদের মাঝে আমি মাধবীলতা দেখেছি আবার মেমসাহেবও দেখেছি। দেখেছি রোহিনী, বসন্ত, জয়িতা। হৈমন্তী, টুনি, কপিলা, চিত্রাঙ্গদাও দেখেছি। তাদের কারো কারো রূপের সুধায় চোখ ঝলসে গিয়েছে হয়ত কখনও। কিন্তু পানি আসেনি সে চোখে। এই পার্বতীই আমাকে নারীত্বের ক্ষমতা দেখিয়েছে। মায়ার বেঁধেছে। ওর প্রতি কোন প্রেম নেই, কোন ভালবাসা নেই, কোন কামনা নেই। আছে শুধু স্নেহ - মায়া। ঘুমন্ত কোন শিশুর মুখের উপর যেমন মায়া হয় তেমন মায়া। সে প্রেমিকা নয়, অর্ধাঙ্গী নয়, বন্ধুও নয়। সে আমার দেবী, সে আমার ঈশ্বরী। ঈশ্বরীর মৃত্যু নেই, বারংবার নবজন্ম হয় তার। তার আত্মাকে অবহেলা করি কি করে আমি এ অধম!


ফিচার ছবিঃ জেএমবি আকাশ