পৃথিবীর আটশো কোটি মানুষ একটি সাধারন রোগে আক্রান্ত- প্রত্যেকেই নিজেকে একা মনে করে। আসলেই তাই। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে আমরা প্রত্যেকেই আত্ববিশ্বাস ও নিশ্চয়তার মুখোশ পরে নেই। কারণ আমরা ভাবি এই মুখোশের আড়ালে মুখ না লুকালে আমরা অন্যদের কাছে ভালনারেবল হয়ে যাবো। এখানেই আমরা সবচেয়ে বড় আত্মপ্রবঞ্চনাটা করি। একটা সময় সেই মুখোশটা আমাদের মুখে এমনভাবে এঁটে যায় যে আমরা চাইলেও সেটাকে আর খুলে ফেলতে পারিনা। অন্তর্মুখিতার শুরুটা হয় তখন থেকেই।
ছোটবেলায় যখন আমরা বাব-মা বা প্রিয়জনদের কাছে কোনকিছু আবদার করতাম এবং তা না পেতাম, তখন কান্না জুড়ে দিতাম। সেখান থেকেই আমাদের মস্তিষ্কে একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যায় যে, যদি কোন কিছু স্বাভাবিকভাবে পাওয়া না যায়, তবে কান্না কর, কান্না করলে অনেক অসাধ্য বস্তুও আরাধ্য হয়। আমরা ভাবি কাঁদলেই আমরা সবকিছু পেয়ে যাবো। পেয়ে যাবো অন্যের স্নেহ, আদর, ভালোবাসা। এখানেই আমরা সবচেয়ে বড় ভুলটা করি। আমরা ভেবে বসি যা কিছু হাসি দিয়ে অর্জন করা যায় না তা সবই কান্না দিয়ে অর্জন করা যায়। হয়ত যায়। কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। একটা সময় পরে এসে আমরা কান্না করতেও পারি না। কারণ আমরা আমাদের অনুভূতিগুলো কারো কাছে প্রকাশ করতে চাই না। আমাদের মনে ভয় কাজ করে। হয়ত স্বার্থপর মানুষগুলো আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিবে।
আমরা সবসময় প্রিয়জনকে আকড়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু একা একা থাকতে থাকতে একটা সময় আসে যখন অন্যলোকের ছায়াও সহ্য হয় না। একা থাকতে ভালো লাগা একটি রোগের নাম। মানুষ অবশ্য একা থাকতে চাওয়া মানুষদের প্রচন্ড অসামাজিক কিংবা অতিরিক্ত অহমিকা সম্পন্ন মানুষ ভাবে। ভাবাটাই স্বাভাবিক। প্রকান্ড দেয়াল তাদের চারিদিকে। সেই দেয়াল টপকে কারো ভেতরের মানুষ দেখার দায় পড়েনি। আনন্দ, ভালোবাসা, দু:খ এড়িয়ে যাবার আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে একা থাকা মানুষদের। প্রচন্ড যত্ন কিংবা ভালোবাসা উপেক্ষা করা; উৎসব কিংবা শোক, সবই এক মনে হয়। চুপচাপ বসে থাকা এক জায়গায়, এই তো ভালো লাগা। কাছে আসতে চাওয়া মানুষজনকে দূরে ঠেলে দেয়া। মাথার উপর ছায়া হতে চাওয়া মানুষদের চরম অবহেলা করা। পরিণতি অবশ্য একই থাকে। দিন শেষে একাই থাকা।
আমরা প্রত্যেকেই রাতে ঘুমাতে যাবার সময় চোখ বন্ধ করে যা ভাবি তা কেউই জানে না। কারণ আমরা জানাতে চাই না। কারণ আমরা ভাবি আমাদের চিন্তাগুলো, ভাবনাগুলো কেউ জেনে গেলে তার কাছে আমরা ভালনারেবল হয়ে যাবো। আমাদের প্রিয় মানুষগুলো আমাদের মাথায় হয়ত হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তারা কি কখনো আমাদের মাথার ভেতরের চিন্তাগুলোতে হাত বুলাতে পারে? জটিল চিন্তা, কুৎসিত চিন্তা, অন্যায় চিন্তা, অশ্লীল চিন্তাগুলো সব সময় অপ্রকাশিতই থেকে যায়। তাই আমরা আমাদের সব চিন্তাগুলো বলার জন্য মুখোশের অন্তরালে একমাত্র নিজেকেই বেছে নিই। কুৎসিত চিন্তাটা কাউকে বলা যাবে না। কেউ জেনে গেলে আমাকে খারাপ মনে করবে। কিন্তু নিজেকে বলা যাবে। কারণ আমি নিজে তো জানি ‘আমি’ আসলে খারাপ না।
কাছের মানুষটি ভুল বুঝতে পারে। তবে মানুষ নিজেকে কখনো ভুল বুঝে না। অন্যের ভুল বোঝার হাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা নিজেদের চারপাশের এক অদৃশ্য প্রাচীর তুলে ফেলি। সেই অদৃশ্য দেয়ালের গহ্বরে নিজেকেই করি নির্বাসিত। নিজেকে ব্যতীত আর কাউকেই আমরা সেই নির্বাসিত গোপন স্থানে প্রবেশাধিকার দেই না। কিন্তু এমন একটা সময় আসে যখন আমরা নিজেরাই সেখানে প্রবেশ করতে পারিনা, এমন একটা সময় আসে যখন আমরা নিজেকেই ভুল বুঝতে শুরু করি। সময়ের ঠিক ওই প্রান্তে গিয়েই আমরা জীবন থেকে ঝরে যাই। আত্মপ্রবঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা আত্মহত্যা করি। আসলে আত্মহত্যা বলে কিছু নাই; সবই বাধ্যতামূলক খুন।