রিক্ত জীবন এখানে জোসনায় পূর্ন হয়ে যায়। সবুজের সাথে পাহাড়ের, পাহাড়ের সাথে মেঘের খুনসুটি চলতেই থাকে। বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে সূর্য্যিদেব তার শেষ বিকেলের লালচে আলোকরশ্মি দিয়ে সে মায়াময়তা যেন বাড়িয়ে দেয় আরও বহুগুণে। ফ্লোরা-ফুনা তাদের রূপের পসরা সাজায়। প্রকৃতি কি শান্ত, কি স্নিগ্ধ! বাইরে বের হয়েই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। আহ! কি টাটকা বাতাস।

হোটেলের সামনেই উঁচু টিলা একটা। এক দৌড়ে উঠে গেলাম চূড়োয়। সামনের রাস্তাযেন স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে রাস্তাটা খাড়া উপড়ে চলে গেছে। উত্তরে বিশাল এক পাহাড়ের দেয়াল। ওই পাহাড়ের চূড়োটাই সান্দাকফু। তার ওপাশেই ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপের রাণী কাঞ্চনজঙ্ঘা। দক্ষিণে যতদূর চোখ যায় সমরেখায় অবস্থিত উচুনিচু ন্যাড়া পাহাড়রাশি। পূবে একটা ছোট্ট এসএসবি(সীমান্ত সুরক্ষা বল) ক্যাম্প। আর পশ্চিমে সেখানে সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে সেদিকে দীর্ঘাকার খাদ। আকাশে তখনও কালো মেঘের ঘোলাটে মশারীটা টাঙানো। এমন হলে আগামীকাল কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পাওয়া যাবে কিনা সে নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবছি তখনই হাওয়া বইতে শুরু করলো। সেই হাওয়ার টানে যেন ঝাঁক বেধে কুয়াশারা উঠে আসছিলো উপরে। গরম পোষাক থাকা সত্ত্বেও যেন হাড়ে কাঁপুনি লাগছিলো।

টিলাটার নিচের দিকে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে গেলাম হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে। খুব বেশী মানুষ নেই, সাত-আটজনের সমন্বয়ে ক্যাম্প। সান্দাকফুতে বড় আর্মি ফাঁড়ি আছে। তাই এখানে অতোটা দরকারও হয় না বোধহয়। তাদেরই একজনের সাথে কথায় কথায় আলাপ হলো। বেশ হাস্যোজ্জল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছ থেকেই শুনতে পেলাম কয়েকদিন আগেই এখানে একজন মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক করে। একে তো অল্টিচুড সিকনেস দেখা দিয়েছিলো তার উপর রাতে মদপান করেছিল। সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

হাটতে হাটতে খাদের দিকে গেলাম কিভাবে ভুরভুর করে নিচ থেকে কুয়াশারা উঠে আসছে দেখার প্রত্যাশায়। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালেই মনে হয় বহু দূর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে কানে। সেই কান্নার শব্দ হৃদয়ে এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। খাদের কিনারায় আসতেই হঠাৎ করে “হোয়াইট আউট” হয়ে গেলাম। সামনে তাকিয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবী বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে। মাউন্টেন ইয়াকের সাথেও আমার পরিচয় এখানেই। আমি যখন কুয়াশার উপরে পড়া বিকেলের রোদের খেলা দেখছিলাম তখন সে আপনমনে ঘাস চিবিয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুটা সামনে এক নেপালী লোক একটি কুকুর নিয়ে বসে বিড়ি টানছেন। এই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতেই শরীর গরম করছেন হয়ত। তারও হাসি হাসি মুখ, দেখে যেন মনে হয় কোন অভাব নেই, কোন দুঃখ-দৈন্য নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এই কারণেই হয়ত পাহাড়ি মানুষগুলোকে আমার এতোটা ভালো লাগে। কোন হিংসা নেই। পর্বতপ্রমাণ অহঙ্কার নিয়ে যে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে তাঁর কোলে বাস করে অহংকার, হিংসা মানব সম্প্রদায়ের শোভা পায় না তাই হয়ত।

খাড়া পাহাড়, পায়ের তলার স্যাঁতস্যাঁতে পাথুরে জমি আর লেডি স্লিপার এবং কুইন ভিক্টোরিয়ার সমারোহ যা এখন ঘোলাটে কুয়াশায় ওড়না জড়িয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যাও প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে যেন শরীরের এতোক্ষন ধরে বেড়ে ওঠা ক্লান্তিটা বেশ ভালোভাবেই ভর করল। সন্ধ্যার সাথে সাথেই উৎকন্ঠা আরও বাড়িয়ে দিতে কাঠ কয়লার মত কালো মেঘে আকাশ পুরো ঢেকে গেল। হঠাৎই দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো। শব্দে কানা তালা লেগে যাওয়ার মত অবস্থা। বারো হাজার ফুট উচ্চতা বলেই হয়তো তার শব্দটা কয়েকহাজারগুন বেশী শোনালো। হিমালয় আমাদের রাজকীয় ভঙ্গীতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

এখানকার জগতে কোন উচ্চকিত ঘটনা ঘটে না। সবকিছুতে হিমালয়ের একটা কোমল, নম্র, মৃদু ভাব। পৃথিবীর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সব মায়া যেন এখানে শিল্পের মত তন্তুজাল বিস্তার করে। বাইরের শব্দময়, ঘটনাবহুল পৃথিবীর প্রবেশ নিষেধ সেখানে। তাই এই কর্কশ, হিংস্র শব্দটি যেন ভিতরের সমস্ত স্পন্দন কয়েক নিমিষের জন্য স্তব্ধ করে দিলো। যেন থেকে গেল রক্তের প্রবাহমানত্, বন্ধ হয়ে গেল হৃৎপিন্ড। সাথে সাথে মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা আসল। একে তো হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, তারউপর বৃষ্টি শুরু হলে তো আর কথাই নেই। তাছাড়া বৃষ্টি হলে অসহায়ের মত তাকালাম চারিপাশে। মাটিতে ভেজা শিশির যেন জমে আছে। খুব তেড়ে বৃষ্টি আসবে। এর সুফল-কুফল দুইটাই আছে। বৃষ্টি হলে এই কাঠ কয়লার মত কালো মেঘ কেটে গিয়ে পরিষ্কার হলেই কেবল আগামীকাল দেখা মিলতে পারে ঘুমন্ত বুদ্ধের। কিন্তু বৃষ্টির স্থায়ীত্বকাল যদি আগামীকাল পর্যন্ত হয় তবে কি করে সান্দাকফু পর্যন্ত পৌঁছাবো সে চিন্তা মস্তিষ্ককে বধ করে রেখেছে। সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে নিতে রুমে ফিরে এলাম।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে কালাপোখারির বুকে। বাড়ছে হাওয়ার তোড়। ইয়োগেন এসে জিজ্ঞেস করে গেল রাতে কি খাবো। পেটের এমন অবস্থা যে কিছু একটা দিয়ে শান্ত করা গেলেই হলো। আমরা যে হোটেলে উঠেছি সে মূলত ইয়োগেনের দূর সম্পর্কের আত্মীয়গোছের কেউ। পরিচয় দিল তার বৌদি বলে। পরিবারে তাদের লোকসংখ্যা মোটে তিনজন। বাবা-মা আর সেই বৌদি। বৌদির বর আছে যদিও। কিন্তু জীবিকার খোঁজে নেপাল গিছেয়ে মাসখানেক আগে। রান্নাঘরে খাবারের কথা বলতে যেতেই সে হিন্দীতে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বুঝি?” এমন প্রশ্নি স্বাভাবিক। তবুও অবাক হবার ভান করে পালটা প্রশ্ন করলাম, “কি করে বুঝলেন।” “বাংলাদেশ থেকে এর আগে যারা এসেছে তাদের দেখেছি বেশ শান্ত হয়। কলকাতা থেকে যারা আসে তারা এসেই এটা লাগবে, ওটা লাগবে বলে মাথা খারাপ করে ফেলে। তাই আন্দাজ করে বলেছি,” সরল উত্তর তার। বেশ গর্ববোধ হল।

রাতের খাবারের কথা বলে এসে কম্বল পেঁচিয়ে বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। শীতকালে আম্মু আমাকে এভাবে আলোয়ানে মুড়ে দিত। বাসার কথা মনে হলেই স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছিলাম। একই সারিতে পাঁচটা খাট বিছানো সামনেই আর একটা খাট আড়াআড়ি ভাবে রাখা। এই ছয়টা খাটেই আমরা ছয়জন বসে বেশ গল্প শুরু করলাম। ক্ষাণিক বাদেই ইগোয়েন এসে জানালো বাইরের অবস্থা ভালো নয়। শীতের প্রকোপ সইতে না পেরে সেও রুমে চলে আসছে। একের পর এক গল্প বলে চলেছে। সেই দম্পতির গল্প যারা একটা আলাদা কক্ষের জন্য তাকে কিভাবে জোড়াজুড়ি করেছি। আবার শীতকালে এই অঞ্চলের মানুষ কি করে জীবনযাপন করে সে গল্প। বাংলা আর হিন্দী মেশানো বাক্যে গল্পগুলো বেশ জমে উঠল।

প্রায় ঘন্টাদুয়েক পরে সেই দিদি এসে জানিয়ে গেল রাতের খাবার হয়ে গেছে, খেয়ে নিয়ে। পরে ঠান্ডা হয়ে গেলে ও খাবার আর মুখে তোলা যাবে না। এ’কদিনে ঠান্ডা শব্দটা এমনভাবে মনের মাঝে গেঁথে গেছে যে শুনলেই শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় একীভূত হয়ে যায়। খেয়ে নেয়াই ভালো। খাবার আইটেম সামান্যই। ভাত, ডাল, সবজি, আচার আর পাপড় ভাজা। তবু যেন অমৃত। ভাত থেকে কেমন জানি একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। নেশা লাগা গন্ধ। কি এমন চাল যে এমন সুগন্ধ আসে জানার বড়ই ইচ্ছে হল। কিন্তু কিভাবে যেন জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। এই অন্ধকারেরও কেমন জানি একটা উচ্ছলতা আছে। সমস্ত শরীরজুড়ে এক অচেনা অজানা অবুভূতি খালা করে যায়। ওপাশের হিমালয়ের সাদা বরফ যেন সন্যাসীর মত চুপচাপ। তীব্র ভালোবাসা নিয়ে প্রতিমূহুর্তে ডেকে যাচ্ছে তার কোলে। ভালোবাসার এই তীব্রতা উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই। তবুও ভয়-শংশয়। আগামীকাল দেখা পাবো কি সেই কাঙ্খিত ভালোবাসার? খাবার পরে চোখ বুঝে বুঝে এসবই ভাবছিলাম। চোখ বুঝলেই চোখের সামনে ক্ষুলে যায় স্বপ্নলোকের হাজারটা দরজা। কাঞ্চনজঙ্ঘ যেন তার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমাকে স্পর্শ করে যায়। সেই স্পর্শ চোখজুড়ে ঘুম নিয়ে আসে। আরও বেশ খানিকক্ষণ সবার সাথে গল্প গুজবে কাটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আরও একটি সকালের অপেক্ষার, স্বপ্নের শেষ ধাপটি পার করার প্রত্যয় নিয়ে।

গভীর ঘুমেই সারারাত পার হয়ে গেল। ক’টা বাজে জানা নেই। ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। কোথায় আছি বুঝতে ক্ষাণিকটা সময় লাগল। বাস্তবে ফিরে আসতেই বিষন্নতা ভর করল সমস্ত মন জুড়ে। আজ বোধহয় আর সান্দাকফু পৌঁছানো হবে না। হবে না ঘুমন্ত বুদ্ধের সাথে জোসনা দেখাও। বাকিদেরও ডেকে তুললাম। ইয়োগেনও এসে হাজির হলো ক্ষাণিকবাদে। সময় পার হচ্ছে। চারদিকে এত অনিশ্চয়তা, এত দুশ্চিন্তা যে ‘স্বাভাবিক’ থাকাটাই রীতিমত অস্বাভাবিক। তবুও আশায় বুক বেঁধে আছি। এ ঝুম বৃষ্টি থেমে নিশ্চয়ই সেই কোমল মায়াময় আলোয় ভরে উঠবে পৃথিবী। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি।

ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবারের কথা বলে চুপচাপ বিষন্ন মনে বৃষ্টি দেখছি। ঘড়িতে সময় আটটা ছাড়িয়ে ন’টা বাজতে চলল। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই নেই। মেঘের গর্জনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টি তোড়। সকালের নাস্তা শেষ করলাম। কিছুই যেন মুখে রোচে না। বুকে একটু চিনচিনে ব্যথা। মরার উপর খাড়ার ঘা দিয়ে ইয়োগেন জানালো এ বৃষ্টি কখন থামবে বলা যাচ্ছে না। আর দুপুর ১২ টার মাঝে রওনা দিতে না পারলে আজ আজ রওনা দেয়া যাবে না। তাহলে আর পৌছাতে পারব না। একে তো তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে তার উপরে এই তোব বাতাস। সবাই মিলে উনুনের পাশে বসে আগুনে হাত পা গুলো অবশ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাচ্ছিলাম।

আরও কিছুক্ষন পরে একটা পাগলাটে ধরণের লোক আসল সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে। হাতে এক বোতল পানি। বৃষ্টি কমার জন্য প্রার্থনা করেছে সেই পানি নিয়েই আসলো। একে একে আমাদের সবাইকে মোটামুটি জোর করেই খাওয়ালো বলা যায়। পরে বুঝলাম পানিতে অ্যালকোহল টাইপ কিছু মেশানো ছিলো। সমস্ত শরীর কেমন জানি একটা ঝিম ধরে গেল। এই ঝড়-বৃষ্ট্র মাঝে লোকটা এলো কি করে সেটাই ভেবে পাই না। দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ ফুর্তিতে আছে। ক্ষাণিকটা নেশা ধরা তোতলানো গলায় একের পর এক গান শুনিয়ে আসর জমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে ওসব কিছুই আর টানছে না। কফি হাতে বাইরে তাকিয়ে আছি।

কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াময় বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ার জন্য যে মন উশখুশ করে আছে তাকে কি আর বৃষ্টির আটকানোর সাধ্য আছে। মনে মনে একরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললাম বলা যায়। বাতাসের তোড়টা যদি সামান্য একটু কমত তবে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রওনা হতাম। কিন্তু দলের বাকিরা? তারা কি আসবে? মনে হয় না। তবুও আশাহত হচ্ছি না। চেষ্টা করতে দোষ কি? বেলা এগারোটা গড়িয়ে চলল। বৃষ্টি না কমলেও বাতাসের ঝাপটা কিছুটা কমে এসেছে। দু’ একটা জীপ গাড়িও আসা-যাওয়া করছে। কেউ যেতে না চাইলে এসব জীপে বলে কয়ে উঠিয়ে দেয়া যাবে।

বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু থামেনি পুরোপুরি। যেটুকু আছে সেটা সামান্য একটা পলিথিন দিয়ে আটকানো যাবে কিনা বুঝতে পারছি না। কিন্তু এছাড়া কোন উপায়ও নেই। এরই মধ্যে তিনজন বেকে বসেছে তারা এই হিম ঠান্ডা আর বৃষ্টির মাঝে ট্রেকিং করে যাওয়ার মত আত্মহত্যার সামিল কাজটা কিছুতেই করবে না। সে আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু দ্বিতীয় একটা স্বত্তা বারবার বলে যাচ্ছে আমি পারব। অনেক খুজে একটা জীপকে রাজি করানো গেলো কিন্তু সেটাতে যায়গার সংকুলান হবে মাত্র তিনজনের। ঠিক হল আমি, শামীম ভাই আর তৌফিক ভাই ট্রেকিং করে যাবো আর বাকিরা জীপে যাবে। ইয়োগেন যাবে আমাদের সাথে।

সামনে কি অপেক্ষা করছে জানি না। আদৌ সান্দাকফু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব কিনা তাও জানি না। সেখানে পৌছেই বা কি অপেক্ষা করছে তাও না। মাত্র ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বৃষ্টিতে ভিজে ট্রেকিং করার পর হাইপোথার্মিয়া হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এই সময়ে হাল ছাড়লে চলবে না। মনের জোরই নিয়ে যাবে সান্দাকফু পর্যন্ত এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা দিয়েই ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম।

ব্যাগ গুছিয়ে, শরীরটাকে দেড় মিটার পলিথিনের মধ্যে পেঁচালাম ঠিকই। কিন্তু মাথা থেকে হাটু পর্যন্ত কোনমতে ঢাকা গেলেও এর নিচে পলিথিন আর পৌছাচ্ছে না। ভালো মানের ট্রেকিং বুট না থাকায় খালি পায়েই ট্রেকিং করতে হবে। কারণ যে বুট আছে সেটা ওয়াটার প্রুফ না। তারউপরে প্যান্টটাকে গুটিয়ে হাটু পর্যন্ত নিয়ে আসছে হয়েছে। সেই অবস্থায় যখন বাইরে একবার পরখ করার জন্য খালি পায়ে ভেজা মাটির উপরে এসে দাঁড়ালাম মনে হলো পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। বৃষ্টির ছাঁট পায়ে লাগতেই মনে হলো কে যানি তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি দিয়ে পা দুটোকে কুচি কুচি করে কাটছে। এই সময়ে মনে জোর রাখা ছাড়া আর কোন করার নেই।

বাকিদের জন্য জীপ আসতে এখনও বেশ দেরী হবে। কিন্তু আমাদের আর অপেক্ষা করলে চলবে না। দুপুর একটা প্রায় বেজে গেছে। এখনই রওনা না দিতে পারলে পৌঁছাতে বেশ দেরী হয়ে যাবে। তাই বাকিদের রেখে আমরা তিনজন বাইরে বেরিয়ে আসলাম গাইড ইয়োগেনকে সাথে নিয়ে। এবার রওনা দেবার পালা। তাপমাত্রা তিন ডিগ্রী সেলসিয়াস। সামনে আট কিলোমিটার স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাওয়া রাস্তা। এর মধ্যেই উচ্চতা অর্জন করতে হবে আরও প্রায় দেড় হাজার ফুট। শরীরে পেরেক ফোটানোর যন্ত্রনা নিয়ে সাথে আছে বৃষ্টি আর কোথাও বাঁধা না পেয়ে হিমালয় ছুয়ে আসা হিম ঠান্ডা ঝড়ো বাতাস। আর একবার পেছন তাকিয়ে শুরু করলাম জীবনের সবচেয়ে সেরা রোমাঞ্চকর আর অ্যাডভেঞ্চার যাত্রা।


জয়িতার খোঁজেঃ সান্দাকফু-ফালুট – ১০