নেশাগ্রস্থ আকাশ, খয়েরী পাহাড়, গোলাপী ইচ্ছে, নীল ভালবাসা, লাল অনুভূতি আর সবুজ জোৎসা। পোড়া মস্তিস্ক, পুড়ে যাওয়া অবছায়া। সবকিছু বেতাল আর অল্প অল্প মাতাল। এমন ঘোর লাগা অনুভুতি নিয়েই শিলিগুড়ির হোটেল রত্নায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গতকাল রাতে। রাতে ঘুম হয়েছে ভালোই। স্বপ্ন দেখেছি এক রূপকথার; যেখানে নেই কোন নগর পতনের শব্দ, নেই কোন যন্ত্রের আর্তনাদ, নেই প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। আছে শুধু ধূসর ধুলোয় লুটানো রডোডেনড্রনের গালিচা, উঁকি দিয়ে মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি অবলোকন। আছে রূপকথার গল্প শোনা।

১০ তারিখ বুদ্ধ পূর্নিমা। জোসনার প্রতি দুর্বলতা সবসময়েই। তাই ঘুমন্ত বুদ্ধের সাথে এবারের বুদ্ধ পূর্ণিমাটা কাটিয়ে ফেলতে পারার এক শিহরন বয়ে যাচ্ছে শিড়দাঁড়া বয়ে। সময় নেই হাতে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজকের মাঝে মানেভাঞ্জন বেজক্যাম্পে পৌঁছাতেই হবে। সাথে আছে খুব কাছে কিন্তু লুকিয়ে থাকা প্রিয়তমাকে দেখতে না পারার অন্তর্লীন বেদনা। অথচ তার খোঁপার কাঁটা বিদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। বর্নহীন হয়ে যাচ্ছে রংধনু। এই ব্যথার তীব্রতা যখন তুঙ্গে তখনই হোটেলের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে এলো।

ভোর সাড়ে ছটা বাজে। এতো ভোরে কাজের লোকটা আসার কথা না। আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুললাম। তাক লাগিয়ে দিয়ে স্বয়ং তৌফিক হাজির! গতকাল ফোনে শুধু হোটেলের নামটা বলে দিয়েছিলাম। ভোর রাতে শিলিগুড়ি পৌঁছেই খুজে খুজে হোটেল বের করে ফেলেছেন। আর ভাগ্য ভালো হলে যা হয়। প্রথম নকও করেছেন নাকি আমাদের রুমেই। জিজ্ঞেস করলাম ফোন দেয় নাই কেন? ফোন দেখালো। এতোটাই ঘোরগ্রস্ত ছিলাম যে তার ৩৯ টা ফোন কলের একটাও টের পাইনি। যাইহোক বকার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে ফিরে খোঁজ নিতে গেলাম বাকি দুই জনের।

সানি ভাইকে ফোন দিলাম। গতকাল রাতে কলকাতা থেকে বাসে রওনা দিয়ে তারা এখনও পথে। জানালো বেশিক্ষন লাগবে না। আমরা যেন তাদের জন্য অপেক্ষা করি। তৌফিক ভাইয়ের প্রস্তাব ততক্ষনে সকালের নাস্তাটা সেরে ফেলার। কিন্তু খাবারের চিন্তা কি আর মাথায় আছে? মাথায় শুধুই কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাকিদের খেতে পাঠিয়ে একা একা বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছি শুভ্র তুষারে প্রভাকরের রক্তিম আলোকছটা দেখার।

সানি আর রিয়াদ ভাই শিলিগুড়ি এসে পৌঁছালেন কাটায় কাটায় সকাল ৯ টায়। হোটেলে আসতে আসলে সাড়ে ন’টা বেজে গেলো। যেতেহু সবাই-ই অপরিচিত, তাই নিজেদের মধ্যে পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলার মাঝেই গতকালের কাজের লোকটাও এসে গেছে। আর দেরী করার কোন মানেই হয় না। তাকে খাবার আনতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ব্যাগ প্যাক করতে। খাবার এসে গেলো ১০ টার মাঝেই। যদিও কাজের লোক দিদিটা “পাইছি ট্যুরিস্ট কামাইয়া লই” নীতিতে আমাদের কাছ থেকে ধোঁকা দিয়ে সামান্য কিছু টাকা এদিক-সেদিক করতে চেয়েছিলো। সব দেখেও চুপ করে বেড়িয়ে আসলাম হোটেল থেকে। যেহেতু কেউই দূর্নীতির উর্ধ্বে না আর সে নিতান্তই গরীব মানুষ তার উপর বাংলাদেশের, তাই কিছুটা বোধহয় মায়া জন্মে গিয়েছিলো। তাই আর কিছু বলিনি।

খাওয়া শেষ করে হোটেল থেকে চেকআউট করে বের হতে ১১ টার মত বেজে গেলো। এরপর মানেভঞ্জনগামী শেয়ার্ড জীপের খোঁজে শিলিগুড়ি জংশন পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে এগারোটা বাজিয়ে ফেললাম। উদ্দেশ্য ঘড়ি আর নিজেদের উভয়েরই বারোটা বাজার আগে জীপ খুজে উঠে পড়া। কিন্তু বিধিবাম! কোন শেয়ার্ড জীপে যাবে না, সবাই রিজার্ভ। ভাড়াও নিতান্ত কম নয়, ৩৫০০ রুপির কমে একজনও নড়বে না। কিন্তু আমার মত ভবঘুরের জন্য তো এই বাজেট নয়। এবারেও উদ্ধার করল ভালোবাসায় জয়িতা। পড়েছিলাম জয়িতারা ঘুম ঘুরে মানেভাঞ্জন হয়ে সান্দাকফু গিয়েছিলো। আমি যদি তাঁর দেখানো পথটাই অনুসরন করি ক্ষতি কি?

জংশনে আশেপাশে একটু খোজ নিয়ে জানতে পারলাম একটার দিকে একটা বাস আছে ঘুম যাবে। চিন্তা করে দেখলাম একটায় যদি বাসে উঠি ঘুম পৌঁছাতে অন্তত চারটা বেজে যাবে। সেখান থেকে যদি সুখিয়া পোখারি বা সরাসরি মানেভাঞ্জনের জীপ পেয়ে যাই তবে তো হয়েই গেলো। যা হবার যখন হবে তখন দেখা যাবে ভেবে ৯০ রুপির টিকেট কেটে বাসে উঠে পড়লাম।

এদের বাস কতৃপক্ষের সময়জ্ঞান বেশ ভালো মনে হলো। বাস ছাড়লো কাঁটায় কাঁটায় একটায়। পরে জানতে পেরেছিলাম দার্জিলিং এ নির্বাচন সামনে। তাই কোন এক সমাবেশ আছে আর রাস্তা বন্ধ করে দিবে। তাই আগে আগে বাস ছেড়েছিলো। বাস যখন দার্জিলিং মোড় পার হয়ে ডান দিকে মোড় নিলো তখন থেকেই স্বর্গরাস্তাটা বোধহয় শুরু হয়ে গিয়েছিলো। দুই পাশে সারি সারি চা বাগান। শুরু হয়ে গেলো ঘোরলাগা। এই পথ ধরেই হয়ত দীপাবলী চলাচল করেছে এমন আকাশ কুসুম কল্পনার সূতোটা ছিড়ে গেলো শামীম ভাইয়ের ডাকে। আমি বসে ছিলাম বাসের বাম পাশে আর ডানপাশে শুরু হয়ে গেলো পাহাডের সারি। আর শামীম ভাই সেটাই ডেকে ডেকে আমাকে দেখাচ্ছিলো। ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিলো না। খুব মন খারাপ করে বসে রইলাম।

বিধাতাও বোধকরি আমার কষ্টটা বুঝতে পেরেছিলেন। মিনিট দশেক পরেই দেখি পাহাড়ের বাঁক ঘুরে সমস্ত পাহাড় সারি তাদের পিঠ উন্মুক্ত করে দিলো আমার সামনে। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার দিয়ে বলি, “হে প্রিয়তমা, তোমার উন্মুক্ত পিঠ আমার কবিতার খাতা। তাও ছন্দহারা কবি আমি; তোমার রূপে নির্বাক, হতবিহব্বল প্রেমী আমি।” ক্যামেরা বের করে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার আগেই পৌঁছাতে হবে বলে বাসও ছুটছে তুলনামূলকভাবে প্রচন্ড গতিতে। আর অজানা বিপিদের আশংকা নিয়ে প্রতি বাঁকেই অপেক্ষা করছে নতুন চমক। সাথে আছে সর্বক্ষণের সঙ্গী দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথ। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর নীলের মেলা। বাড়তি সৌন্দর্য্য যোগ করেছে ঝরে পরা শুকনো পাতা। ইশ্‌! মচমচ শব্দ করে এই পাতার পথ যদি পায়ে মাড়ানোর সুযোগ পাওয়া যেত!

কিন্তু আকর্ষণ যে এখানেই শেষ না তা কে জানত! তখন কার্শিয়ং থেকে কিছুটা পেছনে। ডুবে আছি সবুজ পাহাড়ের মায়ায়। হঠাৎই আবহাওয়া বদলে গেল। আগেই জানতাম পাহাড়ে আবহাওয়ার কোন পূর্বাভাস নেই। এই রোদ , তো এই মেঘ-বৃষ্টি। কিন্তু দার্জিলিং প্রবেশের আগেই যে সেই রূপ দেখতে পাবো সে ভাবিনি। আকাশ কালো করে মেঘে ছেয়ে গেলো। সামান্য কিছুক্ষণেই শুরু হয়ে গেলো ঝড়ো বাতাস, সেই সাথে বজ্র আর শিলা বৃষ্টি। পাশের ছিটে বসে থাকা সানি ভাই বরফ বরফ বলে চিৎকার করে উঠল। পুরো বাস জুড়ে কারো চেহারায় বিরক্তি, কারো চিন্তার ছাপ। কিন্তু আমাদের মত ভ্রমনে যারা এসেছে তাদের মুখগুলো বেশ হাস্যোজ্জল। বাস ছুটে চলেছে সেই ঝড়ো বৃষ্টি উপেক্ষা করেই। আর আমি বসে আছি জানালায়- ক্যামেরা তাক করে। হতাশ হতে হয়নি। কিছু সময়ের ব্যাবধানেই পেয়ে গেলাম বেশ কিছু ফ্রেম। যার মধ্যে পাহাড়ের বুকে বজ্রপাতের একটা ফ্রেম এখন পর্যন্ত আমার খুবই প্রিয় একটা ছবি।

যাত্রা পথে বাস সামান্য কয়েকবারই থেমেছে যাত্রী উঠা-নামা করাতে। এছাড়া ছুটেই চলেছে রোমাঞ্চকর সব বাঁক দিয়ে। সোনাদা পৌঁছাতেই বৃষ্টি কিছুটা থেমে এলো। খুলে দিলাম জানালা। সাথে সাথে শীতের এক প্রচন্ড ধাক্কা বিদ্ধ করল সমস্ত শরীর। এতোক্ষণ সব দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় টের পাইনি শীতের প্রকোপ। মাত্র দুই-তিন ঘন্টা ব্যাবধানে শিলিগুড়ির তাপাদাহ থেকে বেরিয়ে এমন শীতে রীতিমত অবাক হতেই হয়। তাড়াহুড়ো করে শীতের পোষাক পড়ে নিলাম সবাই। নাগরিক জীবনে থেকে এতোটা দূরে এসেও মুক্তি নেই জ্যাম থেকে। সোনাদা পেরিয়েই থেকে শুরু হলো জ্যাম। সেই নির্বাচনী সমাবেশ। মিরিকের রাস্তা বন্ধ করে দেয়ায় সব গাড়ীর চাপ এসে জুটেছে কাশিয়ং এর সাইডে।

ইতিমধ্যে চারটা প্রায় বেজে এসেছে। সেই সাথে বাড়ছে চিন্তা। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারব তো মানেভাঞ্জন। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারলে বেশ কিছু লাভ আছে। কিন্তু তার কোন সম্ভাবনাও দেখছি না। ইচ্ছে করছে বাস থেকে নেমে হাটা শুরু করি। কিন্তু এই জ্যাম ঢাকার জ্যামের মত কিনা কে জানে! কতক্ষনই বা লাগবে তাও জানিনা। ঠিক চারটার দিকে যখন দেখলাম ঘুম আর মাত্র ১ কিলোমিটার তখন আর কোন ভাবাভাবি নেই। নেমে হাটা শুরু করলাম।

এই তাহলে সেই ঘুম স্টেশন? অদ্ভুত সুন্দর একটা স্টেশন। চারপাশ বেশ সাজানো-গোছানো। স্টেশনের সামনেই দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়ের জাদুঘর, একটা সাজানো বাগান। সাদা মেঘ এসে সেই বাগানকে আরও সুশোভিত করেছে। রেললাইনের একটা দিক চলে গেছে দার্জিলিং এর দিকে। আর ছোটবেলায় আমি কি ভাবতাম! সবাই বোধহয় ঘুমিয়েই থাকে এখানে। মনে হতেই হাসি পাচ্ছে। কিন্ত এসব ভাবার এখন সময় নেই। শীতে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছি। সবাই মিলে ভীড় জমিয়েছি স্টেশনের একটা কফি শপে। শীত সাইরাজকে এতোটাই কাবু করে ফেলেছে যে হাতের কাঁপুনিতে কফির মগটাই হাত থেকে ফেলে দিলো।

কফি শেষ করে যখন শরীরের হারানো তাপ কিছুটা অর্জন করেছি এবার মানেভাঞ্জনের জীপ খোজার পালা। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, “আসুন আপনাদের জীপ ঠিক করে দিচ্ছি।” বলেই আমাদের সাথে সাথে হাটতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম দালালের খপ্পরে পড়েছি, কাটাতে হবে। আমরা সবাই তার সাথে যাচ্ছিলাম আর দুইজনকে পাঠিয়ে দিলাম অন্য একটা জীপের খোঁজে। দালাল ব্যাটার সাথে সামান্য তালবাহনা শুরু করতেই বাকি দুইজন একটা জীপ ঠিক করে ফেলল আমাদের ৬ জনের জন্য। আর দালালকে চিনে কে? জীপে উঠে পড়েই দার্জিলিং পর্বে ‘ঘুম’কে আবার দেখতে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিয়ে চললাম আমার বেজক্যাম্প মানেভাঞ্জনের পথে।


জয়িতার খোঁজেঃ সান্দাকফু-ফালুট – ৫