মনের মাঝে তিলেতিলে গড়ে ওঠা স্বপ্ন, মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে জমাট বাঁধা হিমালয়ের হাতছানি। কখন আসবে সেই ক্ষন যখন ভোরের টাটকা আলো কাঞ্চনজঙ্ঘারর উপর প্রজ্জলিত হয়ে, প্রতিফলিত হয়ে স্তব্ধ করে দেবে হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন! যাত্রাপথে বাস বিরতি দিয়েছিল সিরাগঞ্জের হাটিকুমরুলে। সারাদিনের উৎকন্ঠায় খেতেই যে ভুলে গিয়েছিলাম এই প্রথম পেট জানান দিচ্ছিল। কিন্তু খাওয়া কি আর হয়! তাও কোনমতে দুইখানা রুটি আর একটা ডিম পেটে চালান করে দিয়ে বাসে উঠে শুভ্র চূড়োর স্বপ্নে বিভোর হয় ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙে সকালে ৬ টার দিকে তীব্র ঝাঁকুনিতে। এতো বাজে রাস্তাও যে আছে বুড়িমাড়ির মত ব্যস্ত স্থলবন্দরে আছে তা কে জানত! বাস ছুটে চলেছে ভোরের আবছা অন্ধকার ভেদ করে। আর আমি বসে বসে প্রহর গুনছি কখন পৌঁছাবো, কখন ওপারে যাবো, কখন দেখব সেই ভালোবাসার উজ্জল শুভ্র মুখখানা। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সকাল ৮ টার দিকে পাটগ্রাম পেড়িয়ে বাস আমাদের নামিয়ে দিলো ‘শুভ বসুন্ধরা’র কাউন্টারে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। বাস থেকে নেমে খেতে রওনা দেব তখনই শুনতে পেলাম পেছন থেকে ডাকছে কেউ। এই সেই দালাল। দালাল দেখতে এমন হয় বুঝি। বলল, “আপনাদের পাসপোর্ট দিয়ে গিয়ে খেয়ে আসুন। আমি এদিকের কাজ গুছিয়ে রাখছি।” প্রথমবার একা একা বিদেশ ভ্রমন। নিজে থেকে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পোহাতে ইচ্ছে হলো না। ট্রাভেল ট্যাক্সের ৫০০ টাকা আর ঘুষ বাবদ ৩০০ মোট ৮০০ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে চললাম খেতে।

একটু সামনেই একটা হোটেলে খেতে বসেছি এমন সময় শামীম ভাইয়ের ফোন। সে নাকি আমাদের সাথে যাবে। সকালে রংপুর থেকে রওনা দিয়েছে। মিনিট বিশেকের মাঝে পৌছে যাবে। রংপুর! আর মাত্র বিশ মিনিট লাগবে আসতে। এসব খুব ভালো করেই জানা আছে। কম করে হলেও ৪০ মিনিটের আগে পৌছাতে পারবে না তা সে যত যাই বলুক। সেরকম প্রস্তুতি নিয়েই ধীর গতিতে খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করে একটা টুথপেষ্ট কিনে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বেসিনের সামনে দাড়িয়েছি। হঠাৎই সাইরাজের চিৎকার, “তোর ডিএসএলআর কই?” হুড়িমুড়ি করে দৌড়ে এসে দেখি আসলেই তো! আমার ক্যামেরার ব্যাগ কই? কিছুতেই বুঝতে পারছি না কোথায় গেল ব্যাগটা, এখানেই তো রেখেছিলাম। শুরুতেই এমন ধাক্কাটা মেনে নিতে পারছিলাম না। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে মনে হলো একবার খাবার হোটেলে দেখে আসি। খেয়ে এসেছি সেই কখন, এখন গিয়ে কি আর পাওয়া যাবে যদি ফেলেও আসি। আমাকে অবাক করে দিয়ে, আমার ছোট মানসিকতাকে ভুল প্রমান করে হোটেলের মালিক দেখি সযত্নে আমার ক্যামেরার ব্যাগটা রেখে দিয়েছেন। হোটেল মালিকের উদারতা দেখে আমি অবিভূত। ভ্রমনের শুরুতেই এমন একটা ধাক্কা বেশ সতর্ক করে দিলো আমাকে, বিশেষত পাসপোর্টের ক্ষেত্রে।

সব আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ করে অপেক্ষা করছি শামীম ভাইয়ের। সকাল নটা বেজে গেছে কিন্তু তার আর দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত দালাল শিমুলকে রাজি করালাম যে আমরা ইমিগ্রেশনের লাইনে দাড়িয়ে পড়ি সে আসলে আমাদের লাইনে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। ততক্ষনে লাইন বেশ বড় হয়ে গেছে। প্রায় ৩০ জনের পিছনে দাড়িয়ে আছি আর মনে মনে সব ক্ষোভ শামীমের উপরে ঝাড়ছি।

ভীড় ঠেলে ঠুলে প্রায় ১০ টার দিকে যখন ইমিগ্রেশন বুথ থেকে মাত্র ৩ জন পিছনে আছি তখন পঞ্চাশোর্ধ এক বুড়ো ব্যক্তির সাথে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। সে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার পাশের লাইনে। কিন্তু আমাদের লাইনটা দ্রুত এগোচ্ছিল দেখে ফাঁকে এসে ঢুকে পড়তে চেয়েছিলেন। আমি বেশ ভদ্রভাবেই বলেছিলাম, “আঙ্কেল, আপনি তো পাশের লাইনে ছিলেন।” ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন। তাকে এধরনের কথা তাও আমার বয়েসী কেউ বলতে পারেন এমনটা বোধহয় তিনি ভাবেননি কখনও। বেশ প্রতাপের সাথে বলে উঠলেন, " আমি যে লাইনে ইচ্ছা দাঁড়াবো! কি করবে তুমি?" ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। এক কথা-দুই কথায় শেষ পর্যন্ত কর্তব্যরত পুলিশ এসে তাকে বের করে দিল।

ততক্ষনে বেলা সাড়ে দশটা বেজে গেছে আর নানা উটকো ঝামেলায় আমার বেজে গেছে বারোটা। ইচ্ছে ছিল বর্ডার পার করেই সোজা চলে যাবো ডুয়ার্সে। সেটা বোধহয় আর হলো না। এর মধ্যে আমার ছবি তোলা শেষ এবং শামীমের আগমন। শামীম ভাই একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছেন যেন আমি তাকে ফেলে চলে না যাই, সে দু’মিনিটের মাঝেই সব শেষ করে আসছেন। এদিকে আমি ততক্ষনে গুটিগুটি পায়ে হেটো ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়েছি। এপাশের দালাল মশাই বেশ ভালো। ১০০ টাকার বিনিময়ে সব কাজ নিজে থেকেই করিয়ে দিল। সাথে মে এর তাপদাহে ফ্যানের নিচে একখানা চেয়ারেরও ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। দুই পাশের সব কাজ শেষ করে লেট কামার শামীমের জন্য বসে আছি তখনও শান্তি নেই। সেই পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক তখনও আমার পিছু ছাড়েননি। এপারে এসেও আমাকে সমানতালে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার নাতির বয়েসী হয়েও কি করে তার সাথে তর্ক করতে পারলাম, আমাকে দেখে নিবেন। গায়ে লাগালাম না। গত কয়েক বছরের ভ্রমন অভিজ্ঞতায় এমন মানুষের কম সাক্ষাৎ তো আর পেলাম না।

আমাদের লেট কামার চাঁপাই ওরফে শামীম ভাই ইমিগ্রেশন শেষ করতে করতে আমার এবং ঘড়ি দুইটারই বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন। তড়িঘড়ি করে ডলার ভাঙিয়ে, একটা জীপ খুঁজে চড়ে বসলাম শিলিগুড়ির পথে। জীপ চলতে শুরু করল অনিমেষ, দীপাবলির ময়নাগুড়ি, তিস্তা ভেদ করে। দু পাশের চা বাগান আর ভুট্টার ক্ষেত, তিস্তার স্নিগ্ধতা সবকিছু রাস্তার মরীচিকা পড়া গরমকেও ভুলিয়ে দিচ্ছিল বারংবার। আর আমার চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে কল্পনার তুলিতে আঁকা দীপাবলির মুখখানা; যে মুখখানা আমাকে প্রতিনিয়ত মেয়ে না হওয়ার আফসোসের যন্ত্রনায় বিদ্ধ করে। এই ময়নাগুড়ির পথ ধরেই তো সেই ভালোবাসার দীপাবলি সংগ্রাম করে গেছে সারাটি কৈশর। কিংবা এরই কোন চা বাগানে হয়ত অনিমেষ এসে লুকিয়ে ছিল নকশাল আন্দোলনে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঝিমুনি এসে গিয়েছিল কিছুটা। চোখ খুলে দেখি ততক্ষনে শিলিগুড়ি পৌঁছে গেছি। তিনটা বেজে গেছে। জীপ থেকে নেমে ড্রাইভারের হাতে ২০০ রুপি গুজে দিয়ে চলেছি হোটেলের খোঁজে, পেটপুজো না করলেই নয়।


জয়িতার খোঁজেঃ সান্দাকফু-ফালুট – ৩