যাদুর শহরের সব প্রিয় চিরকুটগুলো সোডিয়াম বাতির হলুদ খামে বন্দী করে রেখে এসেছি সেই কবেই। উদ্দেশ্য জীবন থেকে আরেক জীবনে পালিয়ে যাবো। হেটে হেটে বহুদূরের পথ পাড়ি দিয়ে কল্পলোকের রাজ্যে চলে এসেছি, যেখানে পাহাড়ের সাথে মেঘের আবার মেঘের সাথে সূর্যের খুনসুঁটি চলতেই থাকে দিগন্তজুড়ে। এ পর্যন্ত জীবনের সর্বোচ্চ রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। হিমালয়ের হিম ঠান্ডা ঝড়-বৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে রওনা হয়েছি স্বপ্নের পথে যেখানে প্রতি পদক্ষেপে এখন বিপদের গন্ধ। যেকোন মুহূর্তে যেকোন কিছু হয়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে হাইপোথার্মিয়ার মত বিপদের আশংকাও ফেলে দেয়া যায় না।

আমাদের দলে এখন আমরা তিনজন। তাও দলছুট। শত বুঝিয়েও শামীম ভাইকে ঠিক করা গেলো না। সে শরীরের জোর দেখাতে আগে আগে হাটতে শুরু করেছে। আমি আর তৌফিক ভাই একসাথে। আমাদের ক্ষাণিকটা সামনে গাইড ইয়োগেন। বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমলেও ইলশে গুড়ির মত বৃষ্টির ফোঁটা ঝরেই চলেছে। সেই মিহি সূতোর মত বৃষ্টির বৃষ্টি ফোঁটা যখনই শরীর স্পর্শ করছিলো তখনই মনে হচ্ছিলো তীক্ষ্ম, ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ শরীরটাকে কুচি কুচি করে কাটছে। তার উপরে খালি পা। প্রথম হিমালয় অভিযান, সাথে অভিজ্ঞতার অভাব, সব মিলিয়ে প্রস্তুতি ছিলো না কোন। যার ফল ভোগ করছি এখন। সাধারন জুতো, ভিজে গেলে বড্ড অসুবিধায় পড়ে যাবো ভেবে খালি পায়েই এই বৃষ্টির মাঝে চলতে শুরু করেছিলাম। এখন এই ভেজা মাটি, কোথাও জমে থাকা বরফ গলা পানিতে পা দিয়ে মনে হচ্ছে কেউ যে পায়ে একসাথে হাজারটা পেরেক ফোটাচ্ছে।

একেবারে খাড়া রাস্তা। একটু সামনে এগিয়ে বাঁক ঘুরতেই দেখলাম সামনের পাহাড়টা যেন আরও উঁচু আর রাস্তাটা তার গায়ে সিঁড়ির মত লটকানো অবস্থায় আটকানো আছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই টের পেলাম এই হিম ঠান্ডায়ও শরীর জুড়ে কুলকুল করছে ঘাম। বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রাও যে অনেকটা কমে এসেছে তাও বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম। নিশ্বাস নিতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছিলো। বারবার দম নেয়ার জন্য থামতে হচ্ছিলো। এরই মাঝে তৌফিক ভাইকে দেখলাম বার দুয়েক ইনহেলার নিতে। তার শ্বাসকস্টের সমস্যা আছে জানতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই সমস্যা প্রকট হলে বিপদ আরও বাড়বে। জিজ্ঞেস করলাম কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। তৌফিক ভাইয়েরও মনে প্রবল জোর ছিলো। আস্তে করে কোনমতে বললেন এখনও কোন সমস্যা নেই। আমি যেন তার পাশেপাশে থাকি। আর যদি দেখি কথা বলছে না তখন যেন তাকে ইনহেলার দেই। মনের মাঝের ভয়টা আরও প্রকট হলো। এই ঝড়-বাদলের মাঝে কারো কোন সাহায্য পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

আরও মিনিট ত্রিশেক কেটে যাওয়ার পরে সবকিছু খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে। তীব্র হাওয়া এভারেস্টের চূড়ো থেকে নেমে আসা মেঘগুলোকে দার্জিলিং এর দিকে সরিয়ে দিচ্ছিলো। একটু আগে যে ঘন অন্ধকার নেমেছিলো তা চটোপট সরে যাচ্ছে। কিন্তু হাওয়ার বেগ কমছে না সেইভাবে। খানিক এগোতেই ভিখেভাঞ্জন। এখান থেকেই রাস্তা আরও খাড়া। দুপাশে খাদজুড়ে সারি সারি রডোডেনড্রনের সারি। অন্য সময় হলে হয়ত পা ঝুলিয়ে দিতাম খাদে। এককাপ কফি হাতে মুগ্ধ নয়েনে তাকিয়ে থাকতাম রক্তিম রডোডেনড্রনের দিকে। কিংবা ঝড়ে পড়া লাল গালিচায় ধরে হেটে যেতাম। কিন্তু এখন সেই ফুরসতটুকুও নেই। সন্ধ্যে হওয়ার আগেই এই পান্ডববর্জিত যায়গা ছেড়ে সান্দাকফু পৌছাতে না পারলে এখানেই ঠান্ডায় মরতে হবে। তাছাড়া আবহাওয়ারও কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। যেকোন মুহূর্তে আবার ঝড়ো বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। তবে মাথার উপর সামান্য আশ্রয়টুকুও মিলবে না।

চেষ্টা করছিলাম যতটা সম্ভব জোরে পা চালাতে। কিন্তু উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে শরীরের অক্সিজেনের যে ঘাটতি দেখা দিচ্ছিলো তাতে করে জোর পা চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তাছাড়া দম নিতে বারবার থামতে হচ্ছে। ঘোড়ার নালের মত বাক নিয়ে রাস্তাটা উপরে ঊঠে গেল। মেঘের আড়াল ভেদ করে দৃষ্টি যাচ্ছিলো না আর সামনে। এখনো হিমালয়ের সব মুখ ঘোমটার আড়ালে। এমনকি কাছাকাছি পাহাড়গুলোতেও কুয়াশা নেমে এসেছে। কিন্তু এ কদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই বেশ বুঝতে পারছি এই মেঘ, কুয়াশা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বারবার মনে হচ্ছিলো আর একটু সামনে আগালেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

হঠাতই অনুভব করলাম প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। ঝিমুনি চলে আসছে। আরও ভয় দানা বাধতে শুরু করল আপনা আপনিই। এ যে অল্টিচুড সিকনেস নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মাথায় বৃষ্টির পানি লেগেই এই যন্ত্রনা। কিন্তু কোথাও যেন একটু ভয়, একটু শঙ্কা। এই মূহুর্তে ভেতরের শীত বাইরের ঠান্ডাটাকে যেন আচমকা সরিয়ে দিলো। সান্দাকফুর শীতল অপরাহ্নে যে ঠান্ডা হাওয়া সমস্ত উপত্যকায় বয়ে যাচ্ছে তার থেকে বহুগুন শীতলতম অনুভুতি।

হঠাৎই জোর হাওয়া বইতে শুরু করলো। সেই হাওয়ার তোড় এভারেস্ট, মাকালু থেকে নেমে আসা মেঘগুলোকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলো দার্জিলিং এর দিকে। তখন অদৃশ্য বিধাতাও মনে হচ্ছিলো আর বিমাতা সুলভ আচরন করছেন না। মুহুর্তেই মেঘ কেটে গিয়ে যখন এমন দৃশ্য চোখে ধরা দিয়েছিলো যা দেখে মুখ থেকে অস্ফুটেই বের হয়ে আসলো এই তো সেই ক্লিওপেট্রার মত নীল চোখ। মাঝে তার শুভ্র সাদা মনিটা দগদগ করে ডাকছে কোন্‌ এক অদৃশ্য মায়ায়। মনে হচ্ছে একছুটে চলে যাই সব নির্মমতা স্বীকার করে নিয়ে ভালোবাসার টানে। এইতো! আর কয়েকটা বাঁক মাত্র সামনে। মেঘের উপর মেঘ তার উপর মেঘ কিংবা আরো পরের মেঘের সিংহাসনে বসে নিচের পৃথিবীটা দেখবো।

শারীরিক ভাবে অ্যাথলেটিক কখনই ছিলাম না আমি। সম্ভল বলতে যা আছে তা হলো গাধার মত অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারি। কিন্তু এই মুহূর্তে সবই হারিয়ে ফেলছি। আর একটা পা ও সামনে আগাতে পারছি না। মনে হচ্ছে এই বুঝি ব্যাকপ্যাকের ভারে পাশের খাদে পড়ে যাবো। এই মুহুর্তে কোন পরিশ্রমই আর কাজে দিচ্ছে না। একমাত্র প্রেরণা যা আছে তা হলো চূড়োয় পৌছানোর প্রয়াস। মাথায় বৃষ্টির পানি লেগে প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। পাথুরে পথ পিচ্চিল হয়ে আছে। এই বুঝি পা পিছলে গেলো বলে।

আর মাত্র দুটো বাঁক। শরীর জুড়ে কুলকুল করছে ঘাম। ঠিক তখনই আড়াল থেকে রাজেন্দ্ররানীর মত বেড়িয়ে এল কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূর্যের আলো তার শরীরে পড়ায় সোনায়-রূপোয় মিশেল আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী পুরো পৃথিবীটাকেই উপেক্ষা করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এই প্রথম এতোটা কাছ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা। আত্ববিশ্বাসটা কতেকগুন বেড়ে গেল নিমিষেই।

কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘পাহাড়ে কেন যাও?’ আমি থতমত খেয়ে যাই। যে সত্ত্বার বিপরীতে আমার বাস সেই সত্ত্বাকেই আমি তখন প্রশ্ন করি। এই যে প্রায় শুন্য ডিগ্রী তাপমাত্রায়, শরীরে জ্বর নিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে শেষ নিশ্বাস্টুকুও বের হবার জোগাড় তাও কেন? আমার পাশের এই যে মানুষটা বারবার ইনহেলার নিচ্ছে। তাও বা কেন? কেন এই কষ্ট করা? কেউ তো আমাকে বাধ্য করেনি এত কষ্ট করার জন্য? কোন কারনে আমি এই নির্মম যন্ত্রনা সহ্য করছি? এই কষ্ট সহ্য করার জন্য আমি কোন পুরষ্কার পাব না, পেপারে ছবি ছাপাবে না, টিভিতে দেখাবে না, কোন খ্যাতিও পাব না। তবুও কেন? কেন এই যন্ত্রনা সহ্য করা?

আমার অবচেতন মন তখন আমাকে বারংবার মনে করিয়ে দেয়, “Mountains are the cathedrals where I practice my religion.” আমি ভাবতে থাকি। ভাবি হয়ত এই ছবিটা দেখার জন্যই। কিংবা সামনের আরও কোন অদেখা স্বর্গের সন্ধানে। জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। আমার ছোট মাথায় এসব আর ধরে না। মাথায় যন্ত্রনা হয়। শুধু জানি আমি তাকে ভালোবাসি। “Nothing can substitute experience” ভাবতে ভাবতে আমি আর একটি পা বাড়াই আর একটি স্বপ্নলোকের ছবি চোখে নিয়ে শেষ বাঁকটি পেরোতে।