সাজেক সম্পর্কে সবসময়েই একটা নেতিবাচক ধারনা ছিলো। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৮০০ ফুট উচুতে এক পাহাড়ী বস্তিতে মানুষ কেন এতো যায় কখনোই আমার মাথায় ঢুকতো না। নিষ্পাপ, নির্মল প্রকৃতির সাথে কৃত্রিমতা ব্লেন্ড করলে তা যে কতটা বেখাপ্পা লাগে ছবি দেখেই মনের অজান্তে একটা ট্যাবু তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তাই সাজেকে যাবার ইচ্ছা কখনোই জাগেনি। অন্তত ঘাটের পয়সা খরচ করে তো না ই। কিন্তু মানুষ কেন এতো ছুটে যায় তা জানার আগ্রহ বরাবরই ছিলো। তাই এবার যখন ঘাটের পয়সা খরচ না করেই যাবার সুযোগ মিলে গেল তখন আর সেটা হারালাম না।
গিয়ে ক্ষতির থেকে লাভই বরঞ্চ বেশি হয়েছে। নিজের পুরোনো সেই চিন্তাধারা থেকে মুক্তি মিলেছে। আমার মনে হয় পাহাড়ে যাবার স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে। দূর আকাশের ময়ূর নীলিমা উপভোগ করার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই জন্মগত। কিন্তু সবার আর্থিক, শারীরির বা অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে মেঘের ভেলায় চড়ে এই সুন্দর গ্রহটার সৌন্দর্য অবলোকন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এই যেমন আমার বাবার কথাই ধরি। প্রতিবার যখন কোন পাহাড়ের চূড়োয় দাঁড়িয়ে দূরের চূড়োগুলোতে সূর্যের আলোকছটা দেখি তখন মনে হয় যদি বাবাকে এখানে নিয়ে এসে দেখিয়ে বতে পারতাম, “বাবা দেখো ওই যে দূরে তোমার অসীমতার প্রতিবিম্ব দেখা যায়।” কিন্তু বাবার পায়ে একটু সমস্যা থাকায় সিড়ি বাইতেই প্রচন্ড কষ্ট হয় তার, ট্রেকিং তো দূরে থাক সেখানে।
কানাডায় ‘রকি মাউন্টেন হুইলচেয়ার টুরস’ নামে একটা অর্গানাইজেশন আছে, যাদের উদ্দেশ্যই হলো শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদেরও পর্বতের স্বাধীনতা দেয়া কিংবা বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে তাদের বুঝানো যে শারীরিক বাধা কোন বাধাই না যদি তুমি তোমার ভেতরের বারুদটাকে জ্বালিয়ে দিতে পারো। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোন সংগঠনের খোজ আমি জানি না। এখন আমার বাবাকে পাহাড় দেখানোর একমাত্র উপায় এই সাজেকই।
এমন হাজারো সমস্যায় থাকা মানুষজন যারা পাহাড়ে যেতে পারে না অন্তত তাদের জন্য হলেও সাজেকের মত কিছু দরকার। বলছি না দুমলং কিংবা জোতলং-এ পীচঢালা রাস্তা করে রিসোর্ট বানিয়ে দেয়া উচিত। বরং যেটা আছে সেটাকেই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিলে খারাপ হয় না মনে হয়। যেভাবে অপরিকল্পিত ভাবে ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে একের পর এক বস্তির মত করে রিসোর্ট, কটেজ গড়ে উঠছে এগুলো রোধ করে, যদি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা করা যায় তবে কৃত্রিমতাবর্জিত পাহাড়ের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে সবার।
- ২২ অক্টোবর, ২০১৮