ধরুন, বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে জনমানবহীন কোন এক গহীন বনে কোন রকম নিরাপত্তা ছাড়া ‘একা’, আবার বলছি- ‘একা’ একটি তাবুর মাঝে রাত কাটাচ্ছেন। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। তাবুর উপরে বৃষ্টির শব্দ। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস তাবু উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ঘন জঙ্গল। কোন আলো নেই। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। পৃথিবীর কেউ জানে না আপনি কোথায় আছেন। বনের পশুপাখির শব্দ, বুষ্টির টুপটুপ শব্দ, বাতাসের শোঁ শোঁ আর বজ্রপাতের বজ্রধ্বনি। মাঝে মাঝে চোখ ঝলসে যাওয়া বিদ্যুৎ চমকানো। এত ঘন জঙ্গল, এত অন্ধকার যে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কোন উপায়ও নেই। কি অনুভূতি হবে আপনার? কেমন লাগবে? কি করে কাটাবেন সারারাত? এর সাথে যদি বাড়তি টুইস্ট যুক্ত হয়? ঘন্টাখানেক কেটে যাবার পরেও দেখলেন বৃষ্টি থামার কোন নামই নেই, উল্টো বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। আর আপনার তাবু সেই তোড় সামলে রাখতে পারলো না। কলকল করে পানি ঢুকতে শুরু করলো।

আপনার কি অনুভূতি হবে জানি না। তবে আমি যেটা অনুভব করেছি সেটাই লিখতে চেষ্টা করার দুঃসাহসিক কাজ করছি। ডিসকভারী চ্যানেলের সারভাইভাল প্রোগ্রামগুলো দেখে কতবার যে স্বপ্ন দেখেছি এমন অ্যাডভেঞ্চারের; কতবার যে ঘুমের মাঝে বেয়ার গ্রিলস হয়ে গেছি; কতবার যে বিভূতিভূষনের ‘আরণ্যক’, ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ে স্বপ্ন দেখেছি সে শুধু ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু সেই অদেখা স্বর্গানুভূতি যে সত্যিকারে অনুভব করতে পারব রেমা-কালেঙ্গা না গেলে কে বুঝত!

হ্যাঁ, উপরের বর্ণনার মত করেই রাত কাটিয়ে এলাম কালেঙ্গা জঙ্গলে। গিয়েছিলাম ভরা পূর্নিমায় জোৎসা বিলাস করতে, কিন্তু সেই জোৎসা বিলাস মুহূর্তেই বৃষ্টি বিলাসে বদলে গেল।

গত বছর এই সময়ে নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বরে একটা গ্রুপের সাথে জোৎসা বিলাসে গিয়েছিলাম। কিন্তু ৫০ জনের একটা গ্রুপ নিয়ে জোৎসা বিলাস হয় না। হলও তাই। জোৎসা ছিল ঠিকই কিন্তু বিলাসটাই হলো না। এবারে তাই ঠিক করেছিলাম একাই যাবো। সম্ভব হলে শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন স্যারকে নিয়ে যেতাম। শাল, সেগুন গাছের ঘন জঙ্গলে আমি স্যারের পাশে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে হিমু হয়ে জোৎসাস্নান করতাম আর স্যার আমাকে রূপার গল্প বলত; কিংবা মাজেদা খালার। কিন্তু এ শুধুই আমার অলীক কল্পনা।

স্যার নেই। তাই নিঃসঙ্গ হিমুকে একাই যেতে হবে চিন্তা করে টিকেট করে ফেললাম পারাবত এক্সপ্রেসের। উদ্দেশ্য শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে চুনারুঘাট আর চুনারুঘাট থেকে কালেঙ্গা জঙ্গল।

শেষমেষ একা যাওয়া আর হলো না। আরও একটা তাবু যোগ হল। ১০ মার্চ সকাল ৬:৩৫ এ ট্রেন। ট্রেন ধরতে হলে ঘুম থেকে উঠতে হবে ৫ টায়। এত সকালে উঠতে পারব কি পারব না ভেবে ভেবে সারারাত আর ঘুমই হলো না। ৬ টায় একটা ব্যাগ আর তাবু কাঁধে চাপিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। ৬:৩৫ এ কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়লেও বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৭ টা। যখন স্টেশনে পৌঁছাই তখন কাটায় কাটায় সকাল ৭ টা। ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে। দৌড়ে বগি খুজে উঠে পড়লাম। সিলেটের ট্রেনে ভীড়ের কথা আগে জানাই ছিল কিন্তু এতটা যে ভীড় হবে আশা করিনি। নিজের সিট পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারছিলাম না। অনেক ঠেলেঠুলে বসতে পারলাম। প্রায় ২ বঠর পরে ট্রেনে উঠেছি। মনের মধ্যে সুখানুভূতি। বাড়িঘর আর গাছপালাগুলো পেছনে ছুটতে শুরু করেছে। ভৈরব, আখাউড়া, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া একটা একটা করে স্টেশন ছাড়ছি আর একটু একটু করে গন্তব্য কাছে আসছে। আমাদের ট্রেন যখন শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন স্পর্শ করে তখন সকাল সাড়ে ১০ টা।

ট্রেনেই যেহেতু হালকা খাবার কিছু খেয়ে নিয়েছি তাই খাওয়ার আর কোন বালাই নেই। স্টেশনের বাইরে এসেই অটোতে উঠে পড়লাম। অটোতে নতুনব্রীজ পর্যন্ত এসে এবারে সিএনজিতে চুনারুঘাট। চুনারুঘাট থেকে সিএনজি বদল করে জনপ্রতি ৬০ টাকা ভাড়াতে চললাম কালেঙ্গা জঙ্গল। চুনারুঘাট থেকে কালেঙ্গার রাস্তা না যেন রোলার কোস্টার। এত বাজে রাস্তা! খানা-খন্দে ভরা। কিছুদূর যাওয়ার পরে মাটির রাস্তা। ইট-পাথরের গন্ধ সরে নাকে এসে লাগল সেই মাটির পাগল করা গন্ধ। কিন্তু এ গন্ধ খুব বেশি উপভোগ করার জো নেই। রাস্তা আরও বাজে হচ্ছে সামনে। এ রাস্তার বর্ষাকালে চলাচল মোটামোটি অসম্ভব বলা চলে। সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কালেঙ্গা জঙ্গলের গেটে পৌঁছালাম দুপুর ১২ টায়।

প্রচন্ড গরম, ক্লান্তি, ক্ষিদে তিনে মিলে জঙ্গলে দৌড়ে যাবার ইচ্ছাকে দমন করে পাশের হোটেলে ঢুকতে বাধ্য করল। এখানে ভাত মাছের কোন কারবার নেই। সিঙারা, পুরি, কেক, বিস্কুট, চা – এই হতে যাচ্ছে আমাদের আগামী ২ দিনের খাবার। এতকিছুর ভাবার অবকাশ নেই। ঘুরতে এসেছি, খেতে না। পর পর চারটা সিঙারা আর এক কাপ চা পেটে চালান করে দিয়ে টিকেট করে ঢুকে পড়লাম গেটের ভেতরে। রাতে ক্যাম্প করার জন্য বন কর্মকর্তাদের পারমিশন নিতে হবে। কিন্তু সে বিকালে যখন রাতের খাবার কিনতে আসবো তখন এসেও জানানো যাবেখন। আপাতত জঙ্গলে ঢুকে তাবুটা বিছিয়ে একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। বন বিভাগের অফিস, বিজিবি’র ক্যাম্প, স্থানীয়দের বসত-ভিটা, কটেজ ছাড়িয়ে প্রায় মিনেট বিশেক হেঁটে ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। এখানে একটা পানির লেক আছে। মূলত বন্য প্রানীদের পানি খাবার জন্য কৃত্রিমভাবে এটি তৈরী করা হয়েছে। পাশেই একটা টিলার উপরে রয়েছে একটা পর্যবেক্ষন টাওয়ার। এখান থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে বর্ডার। এটাই ক্যাম্প করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হল। ওয়াচ টাওযারের পাশে একটু খালি যায়গায় তাবু ফেলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্ত এ সুখ খুব বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। মাথার উপরে গনগণে সূর্যের প্রতাপে বাইরে বেড়িয়ে আসতেই হলো।

বাইরে এসে ওয়াচ টাওয়ার উপরে উঠে নীল আর সবুজের দিগন্তরেখায় চোখ জুড়িয়ে নিলাম। এখানকার মৃদু বাতাসে শরীর একটু ঠান্ডা হলে সিদ্ধান্ত নিলাম আধা ঘন্টার পায়ে হাটা ট্রেইলটা একবার ঘুরে আসার। যেহেতু সীমান্ত এলাকা আর সাথে গাইড নেই তাই খুব বেশী ভেতরে যাওয়া উচিত হবে না। ভাগ্য ভাল থাকলে এই ছোট ট্রেইলেই অনেক কিছুর সাথে পরিচয় হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন না। পুরো এক ঘন্টায় কয়েকটা কাঠবেড়ালী ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না!

এই গরমে সামনে আস্ত একটা শীতল পানির লেক পড়ে থাকলে কি আর কারো বসে থাকতে ইচ্ছা করে? ঝাপিয়ে পড়লাম পানিতে পাশের গাছ থেকে। যতক্ষন পর্যন্ত না ক্লান্ত হই চলল জলকেলি। গোসল শেষে তিনটার দিকে তাবুতে ফিরে আসি। তখন শরীরে আর এক তোলা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। ঘুমে দুচোখ জুড়িয়ে আসছে। কিন্তু ঘুমালে চলবে না। পাঁচটার আগে বন বিভাগের অফিস থেকে পারমিশন নিতে হবে আর রাতের খাবারও নিয়ে আসতে হবে।

পারমিশনের জন্য অফিসে গিয়ে কাউকে পেলাম না। বিকালের নাস্তা হিসেবে আবারও কয়েকটা সিঙারা গলধঃকরন করে রাতের জন্য বিস্কুট আর কেক নিয়ে তাবুতে ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ করেই মেঘ কালো করে ইলশেগুঁড়ি শুরু হল। পথে দেখা হলো কয়েকজন বিজিবি’র সাথে। আমাদের রাতে থাকার প্লান শুনে তারা বারবার নিষেধ করল, উপজাতিদের ভয় দেখালো, মেছো বাঘ-সাপের ভয় দেখালো। কিন্তু নাছোড়বান্দা। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, এখন কোথাও যাওয়ার উপায় নেই এইসব বুঝিয়ে তাদের রাজি করালাম। শর্ত দিল কটেজের সামনে তাবু করতে হবে। আর তারা কোনরকম নিরাপত্তার দ্বায়ভার নিতে পারবে না। তারপরেও কোন বিপদ হলে জানাতে বলল। আমরা গিয়ে তাবু নিয়ে আসার আশ্বাস দিয়ে চললাম ডেরায়। তাবুতে ফিরে এসে ক্লান্তিতে ঢলে পড়লাম। চারপাশে আধো আধো অন্ধকার শুরু হয়েছে, চলছে ইলশে গুঁডি, সাথে বইতে লাগল। এমন ঠান্ডা আবহাওয়াও ঘুমিয়ে পড়লাম সহজেই। ঘুম ভাঙে পানির স্পর্শে। ইলশেগুড়ি কখন যে কুকুর বেড়াল বৃষ্টি হয়ে গেছে টেরই পাইনি। বৃষ্টির তোড় আমার থ্রি সিজন তাবু আর আটকে রাখতে পারছে না। কলকল করে পানি ঢুকছে তাবুতে। সবকিছু মোটামুটি ভিজতে শুরু করেছে।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা তখন। বাইরে তুমুল বৃষ্টি চলছে। সাথে মেঘের গর্জন আর কিছুক্ষন পর পর তীব্র আলোর ঝলসানি। নিজের তাবু রেখে পাশের তাবুতে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এ তাবুর অবস্থা যা তাতে বেশিক্ষন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তার আগেই কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কারো মাথায়ই কোন কিছু আসছে না। এই ঝড়ের রাতে জঙ্গলে বের হওয়া মানে আত্মহত্যা করা। নিজেদের সব ব্যাগ ওয়ার টাওয়ারের নিচে রেখে এসেছি। উপর থেকে পানি না পড়লেও পাশ থেকে বৃষ্টির ছিটা আসছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছি যে কখন একটু বৃষ্টি কমবে আর আমরা দৌড়ে বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নেব। কিন্তু বৃষ্টি বাবাজি থামার কোন নামও নিচ্ছে না।

রাত সাড়ে আটটা। একঘন্টা ধরে লড়াই করে যাচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতির সাথে কি পারা যায়? এই তাবু থেকেও বৃষ্টির পানি ঢুকছে ছিটে ছিটে। প্রকৃতির কাছে নিতান্তই অসহায় আমরা। অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই। কিছু একটা ব্যাবস্থা এখনই নিতে হবে। সবাই তাবুর বাইরে বের হয়ে পড়িমরি করে দৌড়ে টাওয়ারের নিচে আশ্রয় নিলাম। চোখে নিছুই দেখছি না। টর্চে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকানোর ফ্লাশ লাইটের মত কাজ করছিল। তাতে যা দেখতে পেলাম তাই দিয়েই ভিজে তাবুটা কোন মতে খুলে টাওয়ারের নিচে নিয়ে আসলাম।

টাওয়ারের নিচে বসে বসে তো আর রাত পার করে দেয়া যাবেনা। আর এই সংকীর্ণ যায়গায় তাবু ফেলতেও পারব না। তাও বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচতে কিছু তো একবা ব্যবস্থা করতে হবেই। টাওয়ারের সিড়ির নিচে যে সংকীর্ণ যায়গা তাতে কোনরকমে চেপে-চুপে তাবুটা ফেলে সবাই গোল হয়ে বসে আছি। ঘুমের তো প্রশ্নই আসে না। বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের অবস্থা নাজেহাল। শীতে কাঁপছি। সব ভেজা। একটু উষ্মতার পাওয়ার মতো কিছুই নেই। তোয়ালে নিংড়ে শরীর মুছে নিলাম। বৃষ্টির তোড় বাড়ছেই। সারারাতে বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন দেখছি না। বিজিবি ক্যাম্পে যাওয়ার প্লানও আপাতত বাদ। এই বজ্রবৃষ্টির রাতে জঙ্গলে আত্মহত্যা করার মত হবে কাজটা। কারো ফোনে কোন নেটওয়ার্ক নেই। বিকালে যা একটু পাচ্ছিলাম এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাও নেই। তখনই টের পেলাম পাশে একটা গাছ ভেঙে পড়েছে। এমন একটা গাছ যদি গায়ে পড়ে তবে এ জন্মের মত ভবলীলা সাঙ্গ। টাওয়ারে নোটিশ লাগানো। ঝুকিপূর্ণ টাওয়ার। একসাথে তিনজনের বেশি আহোরন নিষিদ্ধ। ফাটলের অভাব নেই। এই নড়বড়ে টাওয়ার যদি ভেঙে পড়ে তাহলে আর খুজেও পাওয়া যাবে না।

এমন আশংকা নিয়েই রাত দশটা বেজে গেল। বৃষ্টি থামছেই না। শীতে শরীরের অবশ ভাবটা একটু একটু কাটতে শুরু করেছে। তাবুর মধ্যে ব্যাগ নিয়ে তার উপরে আধশোয়া হয়ে বসে আছি এক একজন। সারা রাত এভাবেই কাটাতে হবে ধরে নিয়ে, আল্লাহর উপর ভরসা নিয়ে বসে আছি। কখন সূর্যের আলো দেখব। আদৌ দেখতে পারব কিনা! ঢুলুঢুলু চোখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। শেষবার যখন সময় দেখেছি তখন রাত সাড়ে এগারোটা। এভাবেই জীবনের অন্যতম একটা স্মরনীয় রাত পার করে ফেললাম।