২০১৫ সালের প্রথম দিককার কথা। সেমিষ্টার ফাইনাল পরবর্তী একমাস বন্ধের মধ্যে ১৫ দিনের বিশাল এক পরিকল্পনা করে বসেছি বান্দরবানের। কিন্তু বাসা থেকে কোন ভাবেই অনুমতি মিললো না। শেষ পর্যন্ত রাগারাগি করে কোথাও যাবো না, এমনকি বাড়িতেও যাবো না ভেবে ঢাকায়ই থেকে গেলাম। কিন্তু দুই দিন যেতেই হাঁপিয়ে উঠলাম। এমন করে শুয়ে বসে কি আর দিন পার করা যায়! তৃতীয় দিন রাতে টেবিলের চিপায় চোখে পড়ল প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ স্যারের ‘অপেক্ষা’ বইখানা। গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। সেই সাথে পেয়ে গেলাম আগামী একমাস কাটানোর পরিকল্পনা।

তখন আমার ক্যাননের একটা পয়েন্ট এন্ড স্যুট ক্যামেরা ছিলো। মাথায় তখন কি আকাশ কুসুম কল্পনা ছিলো জানি না। ঐ রাতেই বিক্রয় ডট কমে বিজ্ঞাপন দিয়ে পরদিন ৭০০০ টাকায় বিক্রি করে চলে গেলাম নীলক্ষেত। সারাদিন ঘুরে এপার বাংলার, ওপার বাংলার লেখকদের মিলিয়ে ৬৩০০ টাকায় মোট ৪৮ খানা বই ও এক কার্টুন সিগারেট কিনে বাসায় ফিরে আসলাম।

এরপরের ২৭ দিন ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। কোন যেন এক ঘোরের মধ্যে কাটতে থাকে দিনগুলো। এই দিনগুলোতে আমি একটা সেকেন্ডের জন্যও বাসার বাইরে এমনকি রুমের বাইরেও যাইনি। বুয়া বাজার করে, রান্না করে রুমের সামনে রেখে চলে যেত। খিদে পেলে দরজা খুলে খেয়ে নিতাম। ঘুম পেলে ঘুমাতাম। কি রাত, কি দিন হুশ ছিলো না। আমার মনে আছে এক রাতে সাতকাহন পড়ে ফেলেছিলাম। একদিনে প্রথম আলো। এ এক অন্য জগত, অন্যরকম মুগ্ধতা। প্রতিটা শব্দে নতুন উচ্ছাস, প্রতিটা পৃষ্ঠায় নতুন আমেজ। একমাসে পুরো ৪৮ টা বই-ই পড়ে ফেললাম।

ছোটবেলায় বই পড়া নিষিদ্ধই ছিল বলা যায়। কারণ আমাদের জননীরা আমাদের গল্পের বই পড়তে দেন না, পড়াশুনায় ক্ষতি হবে বলে। শিক্ষকরাও নিষেধ করতেন ইঁচড়েপাকা হয়ে যাবো বলে। গৃহশিক্ষকের অনুমতি সাপেক্ষে দুই-চারখানা জাফর ইকবাল স্যারের সায়েন্স ফিকশন পড়েছি বলে মনে পড়ে। আমার বয়েসী কিশোররা যখন সেবা প্রকাশনীতে ডুকে থাকত তখন সত্যি বলতে আমি এসবের নামই জানতাম না। তাই হয়ত আজও পর্যন্ত আমার তিন গোয়েন্দা পড়া হয়নি। তবে স্কুলে থাকতে লুকিয়ে লুকিয়ে পাঞ্জেরীর কিশোর ক্লাসিক সিরিজ অনেক পড়েছি। এক একটার মূল্য ছিলো তখন ৩০-৩৫ টাকা। একার পক্ষে কেনা সম্ভব না হওয়ায় একটা লাইব্রেরীর মত করেছিলাম। প্রতি সপ্তাহে একটা করে বই কেনা হতো। স্কুল থেকে আমার বাসা সবচেয়ে কাছে হওয়ায় লাইব্রেরীর বইগুলো আমার হেফাজতেই থাকতো। সেগুলো আজ কোথায় আছে কে জানে! স্কুল শেষ হয়ে যাবার পরে উচ্চমাধ্যমিক জীবনের বিক্ষিপ্ত ট্রাজেডির সময়টাতে বইয়ের সংস্পর্শে আর আসা হয়ে ওঠেনি। এরপরে এই ২০১৫ তে আবার বই পড়া।

সুখের সময় হাতের তালু দিয়ে অলক্ষ্যে ঝড়ে গেল বালুর মতন। একমাস পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হলে যখন সেচ্ছায় গৃহবন্দী দশা থেকে লোকালয়ে বেড়িয়ে আসলাম তখন নিজেকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো। এ যেন এক নতুন আমি। আমার সেই ‘আমিত্ব’র বর্ণনা আমি করতে পারবো না। যেন কোন এক অবিনাশী ফিনিক্স পাখির স্পর্শে চিন্তা চেতনাই বদলে গেল। এর পরের সময়গুলো বেশ খাপছাড়া। বই কিনেছি, পড়েছি, রেখে দিয়েছি। কখনো ফিকশন, কখনো নন-ফিকশন, কখনও থ্রিলার। তার পরের সময়গুলো কেটেছে পুরোনো বইগুলোর প্রচ্ছদ নেড়েচেড়েই।

ইদানীং আমি বই পড়তে পারছি না। ঠিক ইদানীং না, এক বছর হলো আমি কোন বই পড়িনা, পড়তে পারিনা। প্রায় প্রতিদিনই খুব আয়েশ করে বসি বই পড়ব৷ কিন্তু ২-৪ পৃষ্টা পড়ার পরেই দুনিয়ার সব ঘুম আমার চোখের পাতায় এসে জড়ো হয়। একটা শব্দ না পড়েই পরবর্তী শব্দে চলে যাওয়ার জন্য মন ছটফট করতে থাকে৷ যেন আর খুব বেশি সময় নেই। এই পৃথিবীতে আর মাত্র কয়েকটি শব্দ বরাদ্দ রয়েছে আমার নামে। তারপর আর কিচ্ছুটি নেই। থামতে হবে। থামার আগে আরও কয়েকটি শব্দ গলাধঃকরণ করে নেয়ার নিষ্প্রভ প্রচেষ্টা৷ ক্ষাণিক বাদেই শুরু হয় যন্ত্রনা। প্রচন্ড যন্ত্রনা। চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় নিজের। বইটাকে ছুড়ে ফেলে শক্ত বিছানায় এলিয়ে দেই শরীরটাকে। তারপরে সব শান্ত। সবকিছু আগের মত।

গত এক বছরে ‘একজন কমলালেবু’ ছাড়া কোন বই সম্পূর্ণ শেষ করতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। তাও শেষ করেছিলাম বোধহয় জীবনবাবুর কারণেই। মাঝে মাঝে অদ্রি পাঠাগার থেকে পাহাড়-পর্বত সম্বন্ধীয় বই-পত্র নিয়ে আসি। অর্ধেকের মত শেষ করি। এরপর ফেরত দিয়ে দেই। রকমারী থেকে ফ্রয়েডের কিছু বই কিনেছিলাম কিছুদিন আগে। এখনও প্যাকেটও খোলা হয়নি সেগুলোর৷ হারারির ‘সেপিয়েন্স’ বইটিও অর্ধেকের কম পড়েই ফেলে রেখেছি ওভাবেই। একজনের চাপাচাপিতে আনিসুল হকের ‘মা’ পড়তে শুরু করেছিলাম। শেষ হয়নি সেটাও। একদিন পড়ব। সব পড়ে ফেলব। সে দিনটা আসুক হুট করেই…

-  ২৭ ভাদ্র, ১৪২৫