ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। বাড়িতে এলে আমার যে সমস্যাটা হয় দিন তারিখ কোন কিছুর আর হিসেব রাখা হয় না। হুট করে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আজ কত তারিখ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। মুঠোফোন দেখে তবেই উত্তর দিতে হয়। আমার বাড়ি একটি নদীর পাড়ে। সন্ধ্যার আড্ডা শেষ করে নদীর পাড়ে একা চুপচাপ বসে আছি। রাতটি শুক্লপক্ষের প্রতিপদ কিংবা দ্বিতীয়া হবে। সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ না থাকলে কোন লাইট পলিউশন না থাকায় আকাশের কোটি কোটি তারায় এক অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি হয় এখানে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল আজ কত তারিখ এটা কি আমি এই তারা দেখে বলতে পারব? কিংবা এই তারা দেখে কি আমি বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিতে পারব? কিছুতেই না।

মহাকাশ, জ্যোর্তিবিদ্যা, কসমোলজি, অ্যাস্ট্রোনমি এসব সম্পর্কে আমার ধারণা শূণ্যের কাছাকাছি। কিন্তু কি আশ্চার্য! প্রাচীন যুগের মানুষ কতই না জ্ঞানী ছিল। তারা নক্ষত্র দেখে দিন, তারিখ, সময়ের হিসেব একেবারে নির্ভুলভভাবে করতে পারতো। নির্ণয় করতে পারতো। অতদূরে যাই কেন? আমার নানাকেও দেখছি, তার বালিশের পাশে সবসময় একখানা ‘নবযুগ পঞ্জিকা’ থাকে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তার প্রথম কাজ সেই পঞ্জিকা দেখা। কত কি যে বলতে পারেন এই পঞ্জিককা দেখে! কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানগগত শিক্ষা খুবই নগন্য। বিজ্ঞান আমাদের যতটা না আধুনিক করেছে তার চেয়ে বেশি করেছে অলস আর মূর্খ। আমরা সবকিছুতেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। অথচ বিজ্ঞান কখনোই এটা চায়নি। বিজ্ঞান চেয়েছিল আমরা যেন ভাবি। ভাবনার খোরাক যোগাতে। জটিলতার উত্তর দিতে, কুটিলতার প্রতিরোধ করতে। কিন্তু আমরা দিন দিন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এই যেমন এখন আমি আমার মুঠোফোন না দেখে কিছুতেই আজকের তারিখটা মনে করতে পারছি না।

আগেই বলেছি মহাকাশ সম্পর্কে আমার ধারণা শূণ্যের কাছাকাছি। ছোটবেলায় আমার মনে বেশ অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন খেলা করত। তেমনই একটা হলো ছবিতে দেখি মহাকাশ কালো দেখায় কিন্তু এটা কি করে সম্ভব। আমি তো বাস্তবে আকাশই নীলই দেখি। এখানে তো সূর্যের মত কত কত নক্ষত্র রয়েছে। সেসব নক্ষত্রের তুলনায় ক্ষুদ্র সূর্যের আলোতেই পৃথিবী উজ্জলতায় ভরে যায়। তাদের আলোতে তো মহাবিশ্ব সবসময় আলোকিত থাকার কথা। আবার দিনের বেলাতে কেনই বা রাতের নক্ষত্রদের দেখতে পাই না। পরে জেনেছিলাম সূর্য থেকে যে সাদা আলো পৃথিবীতে আসে সেই আলো সাতটি রঙের সমষ্টি, বিজ্ঞানী নিউটন প্রিজম দিয়ে বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন। সূর্যের সেই সাদা আলোর একটি রঙ নীল। এই নীল আলোক রশ্মিটি বায়ুমন্ডলের কণাসমূহে বিচ্ছুরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বায়ুমন্ডলে। সে কারণেই আকাশকে নীল মনে হয়। এই উজ্জল নীল আলোই রাতের নক্ষত্রদের ঢেকে রাখে। আবার অনেক সময় আমরা অসম্ভব কিছু বোঝাতে তারা গোনা শব্দটি ব্যবহার করি। মহাবিশ্বে তারার সংখা বস্তুতই অসম্ভব। কিন্তু আমরা কি জানি খালি চোখে দেখা তারাগুলো গুনে শেষ করা মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ উত্তর ও দক্ষিণ দুই গোলার্ধ মিলিয়ে আমরা বড়জোর ৫ থেকে ৬ হাজার তারা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই।

আমাদের সৌরজগত যে গ্যালাক্সীর অন্তর্গত তাকে বলা হয় মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথ। গ্যালাক্সী হলো মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ। অনেকগুলো নক্ষত্র নিয়ে একটি গ্যালাক্সী আর অনেকগুলো গ্যালাক্সী নিয়েই আমাদের এই মহাবিশ্ব। নক্ষত্র, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস, ধুলিকনা, প্লাজমা ও অন্যান্য অনেক বস্তু নিয়ে আমাদের এই গ্যালাক্সী গঠিত। সাধারনত ১০ থেকে ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র নিয়ে এক একটি গ্যালাক্সী তৈরী হয়। ছোট গ্যালাক্সী যেগুলো সাধারণত ১ বিলিয়নের কাছাকাছি নক্ষত্র নিয়ে তৈরী হয় তাকে বামন গ্যালাক্সী আবার ১০০ বিলিয়ন বা কাছাকাছি নক্ষত্র মিলে তৈরী হওয়া গ্যালাক্সীকে দানব গ্যালাক্সী বলে। আমাদের ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ১০০ বিলিয়ন।

আমাদের এই মিল্কিওয়ের গঠন অনেকটা রুটির মত চ্যাপ্টা, গোল। সেই রুটির তলজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ১০ হাজার কোটি বা ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। সেই রুটির ব্যাসার্ধের প্রায় সর্বশেষ প্রান্তে যদি একটা গোল গর্ত করে গর্তটিতে একটি পিঁপড়ে ছেড়ে দেয়া হয় তবে সেই পিঁপড়েটি পুরো রুটিটিকে দেখতে পাবে না। দেখতে পাবে গোল গর্তটির পরিসীমার বলয়টি। এভাবেই আমরা রাতের আকাশে যে বলয়কে ছায়াপথ বলি সেই ছায়াপথ আমাদের গ্যালাক্সীর অংশবিশেষ। আমরা পিঁপড়ে হিসেবে সেই বলয়টিকেই দেখতে পাই। পুরো গ্যালাক্সীকে নয়।

আমাদের সৌরজগত এই ছায়াপথের এক কর্ণারের দিকে অবস্থিত। এখন গ্যালাক্সীর কেন্দ্রে না হয়ে কর্ণারে অবস্থিত হওয়ায় আমাদের আফসোস হতেই পারে। কারণ এই কর্ণারের দিক থেকে আমরা মহাবিশ্বের অনেক কিছুই দেখতে পারি না। যেমন আমাদের কাছাকাছি কোন উজ্জল দানব নক্ষত্র নেই, কোন নীহারিকা নেই, কোন গ্যালাক্সী নেই। আমাদের কাছাকাছি যে গ্যালাক্সী আছে তার নাম এন্ড্রোমিকা। কিন্তু আমরা সেটাও এই কর্ণার থেকে খালি চোখে দেখতে পাই না। ইশ্! সৌরজগত যদি আমাদের গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের দিকে অবস্থিত হত তবে হয়ত আমরা আরও অনেক নক্ষত্র পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবে ধারণাটা ভুল। আমরা যদি ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে থাকতাম তবে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের উজ্জল আলোয় মহাকাশ ভরে থাকতো। তখন সেই আলোর কারণে আমরা ছায়াপথের বাইরের মহাবিশ্বকে অবলোকনই করতে পারতাম না। তাছাড়া আমাদের সৌরজগতের কাছাকাছি আরও নক্ষত্র থাকলে সেসব নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় প্রভাবে সৌরজগত তথা আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ সম্ভব হত না। নক্ষত্রদের মহাকর্ষীয় প্রভাবে প্রচুর উল্কাপাত হত। সেসব উল্কাপাতে আমাদের বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তাই বলা যায় ছায়াপথের কর্ণাণের দিকে আদের সৌরজগত অবস্থান করে আমাদের প্রাণের বিকাশকেই ত্বরাণ্বিত করেছে।

উষার শেষ আলো যেন হালকা নীল বর্ণ। সেই নীলিমায় একটু একটু করে লাগে রক্তিম আভা। এই রক্তিম আভাটুকু মিলিয়ে গেলেই রাত্রির ত্রিভুভনজুড়ে যে নক্ষত্ররাজি জ্বলে ওঠে সেই নক্ষত্রদের চেনা, তাদের সস্পর্কে জানা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, এক ভাবনার খোরাক যোগানোর শখ।

দিগন্তের এই সীমাহীন কালো আকাশ আমাদের নিয়ে যেতে পারে কোন কোন কল্পনার রাজ্যে, ভাবনার আকাশে উন্মুক্ত করতে পারে হাজারো প্রশ্ন; মস্তিষ্কে স্থান পায় অন্তরীক্ষের ভাবনা।