সৃষ্টির আদিতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল নিরাকার এক জগত। সেখানে একপাশে ছিল হিম বরফ অন্য পাশে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগ্নেয় শিলা। কুয়াশায় নিমজ্জিত এক জগত আর নারকীয় আগুন জ্বলতে থাকা এক জগতের উপস্থিতি।

দক্ষিণে ছিল মুসপেল রাজ্য। যেটা ছিল আগুনের রাজ্য। দাউ দাউ করে চারপাশে জ্বলছে আগুনের শিখা। তার উজ্জল শিখা সবকিছুকে বিদগ্ধ করে দেয়। সেখানে জন্মগ্রহন না করলে কারো পক্ষেই সে তাপদাহ সহ্য করা অসম্ভব। তাই সেখানে কিছুই ছিল না। ছিল শুধু কালো সুর্ট নামে অতিকায় এক দানব। দূরবর্তী চূঁড়ায় আগুনের তৈরী তরবারি নিয়ে বসে আছে, ধ্বংসের সবকিছু প্রতিক্ষায়। একদিন সে উঠে দাঁড়াবে আর তার হিংস্রতায় সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। কথিত আছে র‍্যাগনারকের দিন সে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে, হত্যা করবে সকল সৃষ্টি এমনকি দেবতাদেরও। তারপর আপর নতুন করে সৃষ্টির সূচনা ঘটবে।

উত্তরে ছিল নিফেলহেইম নামের আরেকটি রাজ্য। এটি বরফ ও তুষার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল হাভারগেলমির নামক ঝর্ণার প্রস্রবন। এই ঝর্ণা থেকেই অ্যালিভাগার নামক এগারোটি নদীর উৎপত্তি। এই এগারোটি নদীর মধ্যে উত্তাল শীতল স্যাভল ও গুনথারা, টগবগে ফজরোম ও ফিমবুলথুল, ভয়ংকর সিল্ড এবং ঝড়োবেগ সম্পন্ন হ্রিড, স্যাইলাগ, ইলাগ, প্রশস্ত ভিড ও লেইপট এবং জমাট বাঁধা গজোল। কল্পনাতীত শীতল ছিল নিফেলহেইম। ভারী কুয়াশার আচ্ছাদনে সর্বদা ঢেকে থাকত এ রাজ্য। কখনও মাটির উপরে মেঘের মত শিশিরের প্রলেপ লেগে থাকত।

এই দুই রাজ্যের মধ্যে ছিল অসীম বিস্তৃত নিরন্তর শূন্যতা। আকার আকৃতিবিহীন এক বিশাল গহ্বর। এটাই ছিল গিনুঙ্গাগ্যাপ। হাভারগেলমির থেকে বয়ে চলা নদী শূণ্যে মিলিয়ে যেত। তার ফেনিল, সফেন, বিষাক্ত জল ঘনীভূত হয়ে জমাট বেঁধে বরফে পরিনত হত। কখনও সেই বিষ ঝর্ণার মত করে ছিটকে পড়ত যতক্ষন পর্যন্ত তা কঠিন শিশিরে পরিনত না হয়। যেহেতু এই গিনাঙ্গুপ্যাপ গহ্বরের উত্তরাংম ছিল জমাট বাঁধা শীতল বরফ এবং দক্ষিণাংশে ছিল গলিত তপ্ত, তাই মাঝের এই গহ্বরটি ছিল ঠিক যেন গ্রীষ্মের সন্ধ্যার মত শান্ত। মুসপাল থেকে ধেয়ে আসা উষ্ণ বাতাস নিইফেলহেইমের বরফ গলিয়ে দিতে শুরু করল। এই গলিত বরফ বিন্দু বিন্দু করে জমা হতে লাগল মাঝের গহ্বরে। সেই জল থেকেই সৃষ্টি হল ইয়েমির নামক এক অতিকায় দৈত্যের।

ইয়েমির ছিল এক তুষার দানব। যখন সে ঘুমাত তখন তার শরীর ঘামতে থাকত। তার বাম বগল থেকে ধীরে ধীরে নিসৃত ঘাম থেকে এক পুরুষ ও এক নারীর সৃষ্টি হয় এবং পা থেকে আর একটি পুত্রের। ইয়েমিরই সকল তুষার দৈত্যদের আদিপিতা এবং তারা তাকে বলত আউগেলমির।

এরপর যতই দিন যেতে থাকে ততই বরফ গলতে থাকে। বরফ গলতে গলতে এরপরে সৃষ্টি হয় আউদুমলা নামক এক গাভীর। কিস্তু ইয়েমির আউদুমলার বাট নিঃসৃত দুধে তৈরী চারটি নদীই খেয়ে নেয়। ক্রোধে আউদামলির ইয়েমিরের বরফ চাটতে শুরু করে। প্রথম দিন সন্ধ্যায় চাটতে চাটতে আউদালমির দেখতে পায় ইয়েমিরের দেহের বরফ হলে বের হচ্ছে মানুষের মাথার চুল। এরপর দ্বিতীয় দিনে মাথা এবং তৃতীয় দিনে সম্পূর্ণ মানুষটি বেরিয়ে আসে। এর নাম বুরি। বুরি ছিল লম্বা, শক্তিশালী ও সুদর্শন। ধীরে ধীরে তার একটি সন্তানের জন্ম হয় যার নাম বোর। বোর বেস্তালা নামক এক তুষার দৈত্যকে বিয়ে করে এবং তিনটি সন্তানের জন্ম দেয়। প্রথমজন ওডিন, দ্বিতীয়জন ভিলি ও সর্বশেষে ভে।

বোরের এই তিন পুত্র ইয়েমিরকে পছন্দ করত না। ধীরে ধীরে তারা বড় হয়ে উঠতে লাগল এবং ইয়েমিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করল। তারা ইয়েমিরকে আক্রমন করে হত্যা করে। ইয়েমিরের শরীরের রক্ত প্রচন্ড বেগে বের হতে শুরু করে। সেই রক্তের স্রোতে সকল দৈত্যরা ভেসে যায় একমাত্র বেরগেলমির ও তার স্ত্রী বাদে। ওডিন, ভিলি ও ভে ইয়েমিরের দেহ কাঁধে করে গুনিঙ্গাগ্যাপে নিয়ে আসে। অতঃপর তারা ইয়েমিরের দেহ থেকে এই পৃথিবীর সৃস্টি করে। তারা ইয়েমিরের মাংস থেকে পৃথিবীর আকৃতি ও ভেঙে না যাওয়া হাড় থেকে পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি করে, ভেঙে যাওয়া হাড় থেকে পাথর আর রক্তে তৈরী হয় নদী ও সমুদ্র। পৃথিবী সৃষ্টির পর ভ্রাতৃত্রয় এর চারপাশে একটি রিং পড়িয়ে দিল। পৃথিবীকে মনে করা হয় চ্যাপ্টা চাকতির মত যার চারপাশ ঘিরে রয়েছে মহাসমুদ্র। তারা এর নাম দিলো মিডগার্ড।

এরপর তারা ইয়েমিরের কঙ্কাল থেকে আকাশ সৃষ্টি করল এবং তা পৃথিবীর চার প্রান্তে পুঁতে দিল। এভাবেই সৃষ্টি হল পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ। অতঃপর তারা মুসপেলের আগ্নেয় শিখা নিয়ে চাঁদ, সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র তৈরী করল এবং সেগুলোকে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে স্থাপন করল যাতে সেগুলো উপরে স্বর্গ ও নিচে পৃথিবী উভয়কেই আলোকিত করতে পারে। ইয়েরিমের মস্তিষ্ক ছড়িয়ে দিলো আকাশে যা টুকরো টুকরো মেঘ হয়ে ভাসতে থাকে। মিডগার্ডের চারপাশে সাগরে নির্বাসিত করা হলো তুষার দৈত্যদের। ইয়েমিরের চোখের পাপড়ি থেকে সেই দৈত্যদের জন্য তৈরী করা হলো বিশাল প্রাচীর। কিন্তু কোনকিছুই তাঁদের এই সৃষ্টিকে পূর্ণতা দিচ্ছিল না। তারা জানতেন মানুষ সৃষ্টি করতে না পারলে তাদের এই সমস্ত আয়োজন বৃথা।

একদিন তারা তিন ভাই সমুদ্রের ধারে হাটছিলেন। এমন সময় সমুদ্রের তীরে পড়ে থাকতে দেখলেন দুইটি গাছের গুড়ি- একটি অ্যাশ গাছের ও অন্যটি ইমল গাছের। দেবতাত্রয় গুড়িদুটোকে তুলে নিলেন। মানুষের সমান উচ্চতায় কেটে সমুদ্রের ধারের বালির ভেতরে পুতে দিলেন। ওডিন নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বারা সেগুলোর মধ্যে প্রানের সঞ্চার করলেন। ভিলি তাদের ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দান করলেন ও ভে তাদের আকৃতি, চোখ, মুখ, মুখ, কান দান করলেন।

তিন ভাই মিলে একজনকে পুরুষ ও অন্যজনকে নারীর শারীরিক গঠন প্রদান করলেন। তাদের লজ্জা ও শীত নিবারনের জন্য পোষাক তৈরী করে দিলেন। অ্যাশ গাছ থেকে সৃষ্ট পুরুষের নাম দেয়া হল আস্ক ও ইলম গাছ থেকে সৃষ্ট নারীর নাম দেয়া হলো ইলিম্বা। এভাবেই সৃষ্টি করা হলো মানুষকে। তাদেরকে বসবাসের জন্য মিডগার্ডে পাঠানো হলো। এখানে এসে তারা সুখে ঘর সংসার করতে লাগল। তাই আস্ক আর ইলিম্বাই হলো সকল মানুষের আদি পিতা-মাতা। আর ওডিন কে বলা হয় সকল মানুষ ও দেবতার আদি পিতা।

জটাইনহেম নরভিতে এক দৈত্যকন্যা বাস করত, যার নাম ছিল রাত। পরিবারের বাকি সবার মতই তার ছিল অন্ধকারের মতো কালো, স্বচ্ছ চোখ, অনামিশার কেশ। রাত তিনটি বিয়ে করেছিলেন তার প্রথম স্বামীর নাম ছিল নাগালফারী এবং তাদের ছেলে অড, দ্বিতীয় স্বামী ছিল অনার এবং তাদের মেয়ে পৃথিবী; এবং তৃতীয় স্বামী ডেলিং ও তাদের ছেলে দিন সবাই ছিল বোরের পুত্রের সাথে সম্পর্কিত। ওডিন রাত ও তার পুত্র দিনকে নিয়ে আকাশে ঘোড়ায় চালিত রথের মধ্যে বসিয়ে দিলেন এবং ঘোড়াকে নির্দেশ করে দিলেন একদিনের মধ্যে দুইজনকে পুরো পৃথিবী চক্কর দিয়ে আনতে। রাতের ঘোড়া হ্যারিম্ফ্যাসির ছিলো হিমায়িত কেশর। অন্যদিকে দিনের ঘোড়া স্কিনফ্যাক্সির ছিলো উজ্জল কেশর। একারণের দিনের বেলা পৃথিবী এতো উজ্জলভাবে দৃষ্টিগোচর হয়।

মিডগার্ডে বসবাসকারী মুন্ডিলফারী নামে এক ব্যক্তি দুই সন্তানের জনক ছিলেন। তার সন্তানরা এতটাই সুন্দর ছিল যে তিনি তার পুত্রকে চাঁদ এবং তার মেয়েকে সূর্য ডাকতেন। সূর্য গ্লেন নামে একজনকে বিয়ে করেছিল। ওডিন ও তার ভাইদ্বয় এই স্পর্ধায় রেগে যায় এবং তারা তাদের ছিনিয়ে নিয়ে আকাশে সূর্য ও চাঁদের রথের আবদ্ধ করে রাখে। এভাবেই বোরের সন্তারনদের দ্বারা তৈরি নক্ষত্রপুঞ্জগুলি মুসপালে থেকে পৃথিবী আলোকিত করার জন্য।

এভাবেই তারা পৃথিবী তথা মিডগার্ডকে সাজানোর পর ওডিন ও তার দুই ভাই মিডগার্ডের উপরে আসগার্ড নামে একটি শক্তিশালী, উজ্জ্বল দুর্গ নির্মাণ করেন। জাদু এবং মহান দক্ষতা সঙ্গে তিনটি রং দ্বারা এমন ভাবে তৈরি করা হয় যে এটি বিস্ময়কর শক্তিশালী হয়। সমস্ত আইসিরগণ ও অভিবাবকরা আসগার্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। আদি পিতা ওডিন তাদের মধ্যে প্রাচীনতম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। সেখানে বারোটি ঐশ্বরিক দেবতা এবং বারোটি দৈত্য দেবতা এবং অন্যান্য আইসিরদের একটি মহা সমাবেশ ঘটে। আর এখান থেকেই সবকিছুই শুরু, সকল সৃষ্টির।


কৃতজ্ঞতাঃ [১] Penguin book of the Norse myths By Kevin Crossley-Holland ISBN13 - 9780393609097

[২] Norse Mythology Neil Gaiman ISBN13 - 9780394748467