শুনেছিলাম পাহাড় বিনয় শেখায়। পাহাড় থেকে অনেক কিছু শিখলেও বিনয়টাই শেখা বাকি ছিলো। এবারে সেই শিক্ষাটাও পূর্ণ হলো। পাহাড়ের চুঁড়োয় ওঠা বা সামিট করাই সর্বশেষ কথা নয়। পাহাড় থেকে শিখতে হয়। শিখতে হয় শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা। এটাই যেন সারকথা।

পাহাড়ে যাওয়ার নেশাটা দীর্ঘদিনের। চিরাচরিত বান্দরবন কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে কেওক্রাডাং থেকে না হয়ে আমার পাহাড়ে যাওয়াটা শুরু হয়েছিলো এক হাজার ফুটের ছোট্ট এক পাহাড় দিয়ে। সেই যে মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম আর থেমে থাকতে পারিনি।

শেষবার পাহাড়ে গিয়েছিলাম গতবছর মে মাসে, সান্দাকফু-ফালুট। এরপর ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে থেমে থাকতে হয়েছে। কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতরে পাহাড়ের পোকাটা যেন কুটকুট করেই যাচ্ছিলো। এই শহরে কোথাও যেন আর রূপকথা লেখা হয় না। বাস্তবতা আর যান্ত্রিকতা গ্রাস করে নিচ্ছে নিরবধি। গভীর রাতে পাহাড়ের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। বদ্ধঘরে নিঃশ্বাস ফেললেও তা যেন চার দেয়ালে প্রতিফলিত হয় বারংবার। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। একটুকু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকি। মিথ্যে হেতু দিয়ে জীবনের হিসেব মেলানোর এই খেলাটা ঠিক আর সহ্য হচ্ছে না। মনে হয় একছুটে চলে যাই এই নাগরিকতা ছেড়ে পাহাড়ে-অরণ্যে। অরণ্যের ডামাঢোলে আরণ্যক হয়ে যাই, বেসিহেবী এই জীবন খুঁজে নিক তার আপন দর্শন, নিজেকে জানার প্রেরণা।

এমনই যখন অবস্থা, হাতে বেশ কিছু সময়ও মিলেছে তখন মনে হলো যাইনা কোন অরণ্যে। তখন সেপ্টেম্বর মাস। বাংলা পঞ্জিকায় ভাদ্র মাস শেষ হই হই। মানে বর্ষার শেষ সময়। এবছর পাহাড়ের অবস্থা খুব বেশি সুবিধার না। খোদ এভারেস্ট সিজন চলে গেলেও কোন সফলতার সংবাদ পাচ্ছিলাম না। দেশের ভিতরে পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থাও একই রকম। একের পর এক পাহাড় ধ্বস লেগেই আছে। প্রকৃতিও যেন প্রতিশোধের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি আবার একা। তাই একা ঠিক পাহাড়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করলাম রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় ধুপপানি, মুপ্পোছড়া, ন-কাটা, সারদা সহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জিং ট্রেইল রয়েছে। এদিকে যেতে পারলে মন্দ হয় না। অন্তর্জাল ঘেটেঘুটে এবং পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে যখন একটা খসড়া পরিকল্পনা দাঁড় করালাম খরচ দেখে তো মাথায় হাত। প্রথমত এ অঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। আর রিজার্ভ নৌকা ভাড়া নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আর আমার পক্ষে সে খরচ বহন করা কোন ভাবেই সম্ভব না।

কিছুদিন আগে মাসুম ভাই ওদিকে যাওয়ায় কিছু তথ্যের সন্ধানে যোগাযোগ করেছিলাম তার সাথে, যদি কোন ভিন্ন পথ পাওয়া যায়। কিন্তু বিধি সহায় হলো না। মাসুম ভাই বললেন আমরা আজ রাতের বাসে আলীকদমের দিকে যাচ্ছি, চাইরে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারো। ফেসবুকের ইভেন্ট জাতীয় ভ্রমনে কখনোই মন না থাকায় যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর কোন উপায় না পেয়ে সন্ধ্যার দিকে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ছুটলাম গাবতলীর দিকে। উদ্দেশ্য তাদের সাথে যোগ দেব। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ট্রেকিং স্যান্ডেল নিতেই ভুলে গেলাম। আর এই ভুলে যাওয়াই যে এতবড় শিক্ষার কারণ হবে তা কি জানতাম!

যাইহোক, আমাদের পরিকল্পনা ছিলো প্রথম দিন আলীর গুহা আর রাতে মারায়ং তং (মতান্তরে মারাইং তং/ মারাইথং তং/ডং) জাদী পাহাড়ের চুঁড়োয় ক্যাম্পিং। ও পরদিন তুক অ  বা ডামতুয়া  ঝর্ণা। বান্দরবন জেলার আলীকদম আমার কাছে বরাবরই প্রবল আগ্রহের যায়গা। এর একমাত্র কারণ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে পাহাড়খেকো দোপেয়ে দৈত্যদের আগ্রাসন কম হয়েছে। এজন্য প্রকৃতিও অনেকটা আপন খেয়ালে রয়েছে। তাছাড়া এই অঞ্চলেই রয়েছে অনেক ব্যর্থতার স্মৃতি। টাইফয়েড নিয়ে ফিরে গিয়েছি কির্সতং যাত্রায়। সেসব বারবার স্মৃতিকাতর করে দেয়।

ভোরবেলা চকোরিয়া নেমে গাইড ফারুককে সাথে নিয়ে চললাম আলীকদমের দিকে। সারাদিন এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে শেষ বিকেলে মারায়ং তং এ পৌঁছানো, এই ছিলো পরিকল্পনা। আলীর গুহা যেতে হলে প্রথমেই আলীকদম থেকে তিন কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে যেতে হবে মংচুপ্র  পাড়ায়। এই পাড়ার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে মাতামুহুরি নদী। মুগ্ধ আমি মাতামুহুরির সৌন্দর্যে। নদীতে হাটু পানি, উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। এই খাল ধরেই আরও গহীনে যেতে থাকলে পৌঁছে যাওয়া যাবে রূপমুহুরী, সাইংপ্র, খিং। মন যেন সেদিকেই টানে। আলীর গুহার সৌন্দর্য্যও কম নয়। এ গুহাকে নিয়েও রহস্য আর লোককথার অন্ত নেই। সারাদিন আলীর সুড়ঙ্গে কাটিয়ে দুপুরের দিকে চললাম মারায়ং তং এর উদ্দেশ্যে।

ক্যাম্পিংয়ের জন্য রেশন কিনে নিয়েছি আলীকদম বাজার থেকেই। এসবের দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ফারুকের উপরে। আমরা শুধু ভাগের রেশন বয়ে নিয়ে যাবো। আলীর সুড়ঙ্গ থেকে ফিরে যখন আলীকদম আবাসিকে পৌঁছেছি তখন ঘড়ির কাটা দুপুর তিনটে ছুঁই ছুঁই। আবাসিকের সামনেই বেশ বড়সহ একটা পুকুর। এমন শান্ত পুকুরের কাকচক্ষু জলে শরীর ভিজিয়ে নেবার লোভ সংবরণ করা প্রায় অসম্ভবই বটে। জলকেলি শেষ করে পানি, রান্নার সরঞ্জাম নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করে যখন মারায়ং তং এর দিকে রওনা দেই তখন সূর্য ডুবে ডুবে অবস্থা। মাত্র ঘন্টা দুয়েকের চড়াই। তেমন কঠিন কিছু মনে হলো না। ভুল করে জুতা ফেলে আসায় সারদিন খালি পায়েই ট্রেকিং করতে হয়েছে। তেমন কঠিন কিছুই মনে হয়নি। খালি পায়ে ট্রেকিং করার অভ্যাস তো রয়েছেই। অনেকক্ষেত্রে বরং সুবিধাই পাওয়া যায়। খালি পায়ে সেই হিম ঠান্ডার মধ্যে সান্দাকফু ট্রেক করে আসলাম। এই ছোট পাহাড়ে কি আর এমন হবে! এই অহংকারটুকুই যে এমন ভূপতিত হবে কঠিন ও যন্ত্রনাদায়ক শিক্ষার মাধ্যমে তা কে জানত!

মারায়ং তং এর ১৬৫০ ফুট যার পুরোটাই চড়াই পথ। অর্ধেক আবার আধপাকা রাস্তা। মানে ইট বাঁধানো রাস্তা। প্রতিবছর মাঘমাসে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মেলা পরিচালিত হয় মারায়ং তং জাদীতে। তাদের সুবিধার জন্যই এই রাস্তা বানানো। বর্ষার কারণে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে পুরোটা রাস্তা। হাটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মাত্র দুই ঘন্টাই তো। পাত্তা দিলাম না। হাটতে হাটতে যখন পাহাড়ে একমাত্র পাড়াতে পানি ও অন্যান্য কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের জন্য থামলাম ততক্ষণে সূর্য্যিমামা পাহাড়ের খাঁজে ডুব দিয়েছে। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ পাহাড়ের বুকে নেমে আসছে ঘন অন্ধকার। ইতিমধ্যে ইটের রাস্তাও শেষ হওয়ায় শান্তির নিশ্বাস পড়লো।

বাকিটা পথ বেশ ভালোভাবেই পেরিয়ে যখন চুঁড়োয় পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে সাতটা বা আটটা বাজে। ফারুক ভাই যখন আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত তখন সারাদিন পরে একটু স্বস্তির বিশ্রাম নেয়ার অবকাশ পেলাম। তাবু পিচ করে আকাশের দিকে চোখ পড়তেই চোখ ছাড়াবড়া হয়ে গেল। পুরোপুরি থ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর, অপার্থিব আকাশ আমি আগে কখনো বোধহয় দেখিনি। পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়ানো আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে তথা আমাদের গ্যালাক্সী তার সৌন্দর্য্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। ঘোর লাগা অনুভূতি ঝেড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ফটোগ্রাফিতে। চমৎকার কিছু লং এক্সপোজার ছবি তুলে ক্ষান্ত হলাম। কিন্তু আকাশগঙ্গার ঘোর আর কাটে না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত বারোটার মাঝে সবাই ঘুমিয়ে পগলেও আমি আর আশা আপু জেগে ছিলাম গভীর রাত পর্যন্ত। রাত দুটোর দিকে আশা আপুও ঘুমাতে চলে গেলেও আমি কানে ডেনভার চালিয়ে বসেই ছিলাম অবাক নয়নে। কখন ঠিক ঘুমাতে গিয়েছি জানি না। তবে শেষবার যখন ঘড়ি দেখেছিলাম তখন ঘড়িতে রাত তিনটা।

আগের দিনের রাত করে ঘুমানোই হোক কিংবা ক্লান্তিই হোক বেশ জম্পেশ একটা ঘুমের কারণে মুঠোফোনের এলার্ম আর কানে গেলো না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো মাসুম ভাইয়ের ডাকে। সূর্য্যিদেব তখন উঠি উঠি করছে। পারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে তার রক্তিম আভা। নিচে পুরো মিরিঞ্জা রেঞ্জ শুভ্র চাদরে ঢেকে আছে। সূর্যোদয়ের রক্তিম দিগন্ত আর তার উপর সাদা মেঘের আবরন যেন এক অপার্থিব মায়াময়তা সৃষ্টি করছে। সমস্ত শরীর একটি আবেশে জড়ানো। উষার প্রথম আলো যেন হালকা নীল বর্ণ। সেই নীলিমায় একটু একটু করে লাগছে রক্তিম আভা। একটার পর একটা পর্দা যেন সরে যাচ্ছে। এতদিনের চেনা বিশ্বের বদলে উদ্ভাসিত হচ্ছে এক নতুন বিশ্ব। হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠে বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার রশ্মি। এই মেঘের চাদর নিয়ে আমার অলস মস্তিষ্কের একটি হাইপোথিসিস আমি দাঁড় করেছিলাম-

উপর থেকে সবকিছুই সুন্দর, অপরূপ। যতই গভীরে যাও সবকিছু ততই তিতকুটে, ততই বিষাক্ত। মাঝে মাঝে তা এতটাই তিক্ত যে বিধাতাও বোধহয় তা অবলোকন করতে চান না। তাইতো ভোরের প্রথম প্রহরের মত মায়াময় পবিত্র একটা সময়ে পুরো পৃথিবীকে সাদা মেঘের মশারী দিয়ে ঢেকে রাখেন যাতে করে সমগ্র বিশ্বভ্রাহ্মন্ডের সকল রহস্যের থেকেও জটিল, কুৎসিত মানুষের মনটা তাঁর দৃষ্টিগোচর না হয়।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে গেল। কিন্তু এখন আর বসে থাকলে চলবে না। আজকের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিচে নেমে সকাল আটটার মাঝে যাত্রা করতে হবে তুক অ বা ডামতুয়া ঝর্ণার দিকে।

ক্যাম্প গুছিয়ে ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে রওনা দিলাম ডিসেন্টে। বাকিদের সামনে সামনে যেতে দিয়ে আমি হাটছিলাম ধীরে ধীরে, ছবি তুলতে তুলতে। মাটির পথটা পেরিয়ে যখন ইট বাঁধানো রাস্তাটা শুরু হলো তখনই ঘটলো বিপত্তি। একে তো শ্যাওলা জমে সবকিছু স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে, তার উপর সকাল স্নিগ্ধ শিশির পড়ে রাস্তা যেন দ্বিগুন পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি আমার আত্মবিশ্বাস স্বরূপ আত্মঅহংকারে নিমজ্জিত- ‘ধুর! কোন ছাই হবে! সেই ভয়ংকর রাস্তাই বৃষ্টির মাঝে খালি পায়ে প্রায় শূণ্য ডিগ্রী তাপমাত্রায় ট্রেক করেছি। আর এ তো মাত্র দেড় হাজার ফুটের একটা ছোট্ট পাহাড়।

এই অহংকারই আমার জন্য কাল হয়ে এলো, পতন ঘটলো। দলের সবাই সামনে চলে গিয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে তাদের ধরতে গিয়ে জোরে পা চালাতেই বা পায়ের আঙুলগুলো স্লিপ করে উল্টোভাবে পড়ে গেল মচকে। ক্ষাণিকের জন্য যেন সব উবে গেল। প্রচন্ড যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠলাম। পা চালানো তো দূরে থাক, কিছুতেই উঠে দাঁড়াতেও পারছি না। ভুলটা আমারই। একটু কষ্ট হলেও অহমিকাটা দূরে ঠেলে রাস্তার পাশের ঢাল ধরে হেটে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু এখন যখন হুঁশ ফিরেছে তখন প্রকৃতির কাছে সম্পূর্ণরূপে অসহায় আমি। সাহায্যের আশার চিৎকার করে ডাকলাম দলের বাকিদের। কিন্তু সে চিৎকার নিজের কানেই প্রতিধ্বনিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হলো না। আরও ক্ষাণিকটা সময় ধরে আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, প্রচন্ড ব্যথায় কোৎ কোৎ করতে করতে নিচে নামতে শুরু করলাম।

যখন নিচে নেমে এলাম তখন পা যেন পুরোপুরি অবশ হয়ে গিয়েছে। ভেঙেছে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান। কিন্তু আমি জানি আমাদের আজকের পরিকল্পনা। এই অবস্থায় আমার এই দুর্ভোগের কথা বলে দলের বাকি সদস্যদের পরিকল্পনা নষ্ট করাকে নিতান্তই স্বার্থপরতা মনে হলো। তাই সামন্য মচকানো ব্যথা বলেই ব্যাপারটাকে চালিয়ে নিতে চাইলাম। ইতিমধ্যে খুব সম্ভবত শান্ত ভাই কিংবা জন ভাই তার অতিরিক্ত নিয়ে আসা একজোড়া জুতা আমাকে দিয়ে দিলো। কিন্তু এ এখন আর কোন কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যথায় জুতার বেল্টের মাঝে পা গলানোই দায়। তাও কোনরকমে দুই বেল্টের ফাঁকে পা দুটো গলিয়ে দিয়ে আবাসিক সকালের নাস্তা সেরে উঠে বসলাম মোটরবাইকে। উদ্দেশ্য আলীকদম ১৭ কিলো। চলছি দেশের সর্বোচ্চ রাস্তা ধরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচ্চতায় নির্মিত আলীকদম-থানচি সড়ক। ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড় ভেদ করে ১২ ফুট চওড়া ও ৩৫ কিলোমিটার সড়কটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে থানচি উপজেলা থেকে আলীকদম উপজেলায়। তারই দুপাশে নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু ব্যথায়, যন্ত্রনায় সবকিছুই কেমন যেন তিতকুটে লাগছে।

১১ কিলো পৌঁছে আর্মিক্যাম্প থেকে পারমিশন নেবার সময়ে বলে দিলো বিকেল পাঁচটার মাঝে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। এরপর যখন ১৭ কিলো পৌঁছালাম তখন বুঝলাম ব্যথাটা এতোক্ষণে জমে গিয়েছে। তখনও আমি আত্মঘাতী। এখন লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে কি করে সেসময়ে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। কাউকে কিছু বলছি না পাছে আমাকে এখানে রেখেই চলে যায়। ‘ব্যাথা অনেকটা উপশম হয়েছে’ এমন আশ্বাস দিয়েই পুরো দল নিয়ে চলতে শুরু করলাম। কখনো মাসুম ভাইয়ের কাঁধে, কখনো শান্ত ভাইয়ের আবার কখনো অনিকের কাঁধে ভর করে জানিনা কোন সঞ্জীবনীর সন্ধানে। মোটামুটি হামাগুড়ি দিয়েই এগোচ্ছি আদুপাড়া ছাড়িয়ে তংপ্র ঝর্ণাকে বামে রেখে মেম্বারপাড়ার দিকে।

মেম্বারপাড়ার আগের চড়াইটা পেরোতেই মনে হলো জ্ঞান হারাবার দশা। তখন দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। এই শম্বুক গতিতে চলতে থাকলে কোন ভাবেই বিকাল পাঁচটার আগে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আমার একার জন্য বিপদে পড়তে হবে পুরো দলকে। তাই বাকিদের পাঠিয়ে দিয়ে থেকে গেলাম মেম্বার পাড়াতেই।

মেম্বারপাড়ার একটা বারান্দায় পায়ে পট্টি বেঁধে বসে বসে ভাবছিলাম পাহাড়ে এখনও অনেক কিছু শেখার আছে। ভাবছিলাম কি কি শিখলাম এবারে।

পাহাড়কে কখনও জয় করা যায় না। পাহাড়কে ভালোবাসতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়, বিনয়ী হতে হয়, শিক্ষা নিতে হয়। জীবনে বাঁচতে গেলে ব্যর্থতা, করূণা, অবহেলা, ভুলের দরকার আছে। কিছু একটা করার প্রেরণা তো এখান থেকেই আসে। আবার পাহাড়ই আমাকে শিক্ষা দেয় ভুল শুধরে নেবার।

যেদিন পৃথিবীর মানুষ ভিটেমাটি বিক্রি করে বোতল বোতল নিখাদ অক্সিজেন কিনবে, যেদিন গোবর পঁচা গন্ধ মেশানো মাটির বিনিময়ে কিনবে প্রযুক্তি। যেদিন থাকবে না নাগরিক কাকডাকা ভোর, থাকবে না শিশির ভেজা স্নিগ্ধ সকাল কিংবা কুয়াশার জড়ানো জোৎস্না। থাকবে একটা বুড়ো আঙুল, একটা স্মার্টফোন, একটা বোকাবাক্স। সেদিন মানুষ সভ্যতা বেচে সুখ কিনবে সেদিন আমি সিদ্ধার্থের মত জোৎসা ছড়ানো রাতে গৃহত্যাগী হবো; পাহাড়কে ভালোবেসে পাহাড়ের বুকে হারিয়ে যাবো। ততদিন তো পা দুটোকে সম্বল হিসেবে রাখতে হবে। নাকি?

ডাক্তার, হসপিটাল এসব আমার কখনই ভালো লাগে না। ফিরে এসে বেশ কয়েকদিন বিশ্রামে পায়ের ব্যথাটা সেরে গিয়েছিলো। কিন্তু এখনও একটানা ৫-৬ ঘন্টা ট্রেকিং করতে থাকলে পায়ের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। যেন আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায় -

পাহাড়কে জয় করা যায় না। ভালোবাসতে হয়। শ্রদ্ধা করতে হয়।

আলীর গুহাঃ আলীর গুহা বা আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে রহস্য আর মিথের শেষ নেই। সরকারি নথিপথে এটাকে পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু যে সুড়ঙ্গটার নাম আলীর নামে তা কিন্তু নয়, যে পাহাড়ে এই গুহার অবস্থান তার নামও আলীর পাহাড়। আর উপজেলার নাম আলীকদম। এই আলীকদম, আলীর পাহাড় আর আলীর গুহা একসূত্রে গাঁথা বলে ধারণা করা যায়। আলীর সুড়ঙ্গটি কীভাবে তৈরি হলো এই ইতিহাস অজানা। তবে এই সুড়ঙ্গ নিয়ে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। বহুল প্রচলিত ধারণা হলো, ‘আলোহক্যডং’ থেকে আলীকদম নামটির জন্ম। যার অর্থ পাহাড় আর নদীর মধ্যবর্তী স্থান। বান্দরবানের রাজা বোমাং সার্কেল চিফ এর নথিপত্রে ও পাকিস্তান আমলের মানচিত্রে আলোহক্যডং নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো মানচিত্রেও (Ensea Det Bengalla) পর্তুগীজ পণ্ডিত জোয়াও জে বারোজ (Jao De Barros) আলোহক্যডং নামটি ব্যবহার করেছেন। আরকানি ভাষায় অনেক পাহাড় ও জায়গার নামে ডং, থং বা দং উপসর্গ জুড়ে আছে। সম্ভবত ডং মানেই পাহাড়। তাই ধারণা করা হয়, তাজিংডং ও কেওক্রাডং পাহাড়ের মতোই আলোহক্যডং একটি পাহাড়ের নাম, যা কালক্রমে আলীকদম নাম নিয়েছে। আবার বিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টিএইচ লুইন এর মতে, ALLEY KINGDOM থেকে ALIKADAM নাম হয়েছে। তার মতে, ALLEY অর্থ দমন, আর KINGDOM অর্থ রাজ্য। জনশ্রুতি আছে- ১৮ জন আরাকানি রাজা রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে মুসলিম হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৪৩৪-৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শাসন কাজ পরিচালনা করেন রাজা মংখারি। তাঁর মুসলিম উপাধি ছিল ‘আলী খাঁন’। ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে রাজত্ব করেন রাজা থাজাথা। তাঁর মুসলিম উপাধি ছিল আলী শাহ। এ কারণে এলাকার নাম আলীকদম। সুড়ঙ্গের নাম আলীগুহা হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেন , ৬০ আউলিয়া উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে একটি অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামের জয় নিশান উড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আলী নামের কোনো আউলিয়া থাকতে পারেন। যাঁর পদধূলিতে নাম হয়েছে আলীকদম বা আলী গুহা।

 


তথ্য সহায়তাঃ

[১] বাংলার ট্রেকার।

[২] প্রথম আলো

[৩] বাংলা নিউজ ২৪