নগরের এই শহুরে শরীরে উৎসব গামী কিংবা উৎসব ফেরত মানুষের শব্দের মিছিল। কত শব্দ, কত কোলাহল, কত উন্মাদনা। এত কিছুর ভীড়েও নিরবে, নিঃশব্দে শরীরটাকে নিজের রিক্সায় এলিয়ে দিয়েছেন জালাল মিয়া। কি আর করবেন! সারাদিন পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রযন্ত্রের বোঝা বইতে বইতে যে বড্ড ক্লান্ত তিনি, বড্ড পরিশ্রান্ত।

রাত আড়াইটে। হাসপাতালের সিসিইউ’র বাইরে লোহার শক্ত চেয়ারে বসে থাকতে কোমড় শক্ত হয়ে গেছে। একটু হাঁটাচলার জন্য বাইরে দেখতে পাই জালাল মিয়াকে। নিজের রিক্সার হুডে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছেন। সামনে পড়ে আছে গোবর ও ডাস্টবিনের ময়লা। সেই তীব্র ঝাঝালো গন্ধের মাঝেও ঘুমাচ্ছেন অঘোরে।

এরকম মানুষগুলোর দিকে তাকালে আমি মনে মনে একটা গল্প দাঁড় করিয়ে ফেলি। এরপর মানুষগুলোর সাথে কথা বলে গল্প আর বাস্তবতা মেলানোর চেষ্টা করি। কিন্তু জালাল মিয়ার সাথে কথা বলার তো উপায় নেই। হয়ত গত দুই দিন ঘুমায় নি, হয়ত থাকার যায়গা নেই। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তবুও একটু আশা নিয়ে অদূরে একটা টংয়ে বসলাম। যদি ঘুম থেকে ওঠে। ক্ষানিকবাদে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ঘুম থেকে উঠলেন। তখনই কথা হলো তার সাথে।

বাড়ি নেত্রকোনা। জীবিকার সন্ধানে এসেছিলেন ঢাকায়। থাকতেন কাছেই একটা ঝুপড়িতে। মাসিক আট’শ টাকায়। বাবা নেই। বাড়িতে অসুস্থ মা। সাথে স্ত্রী ছেলে মেয়ে। তবুও টেনে টুনে সংসার চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু গতমাসে হঠাৎ করে মা স্ট্রোক করার পর খরচ বেড়ে গেছে আরও। বাড়িতে টাকা পাঠাতেও হয় বেশি। তাই এমাস থেকে ঝুপড়ি থেকে এই রিক্সাখানাকেই বানিয়ে নিয়েছেন তার অস্থায়ী সংসার। বলছিলেন- ‘ভাইজান। ঝুপড়ি ছাড়া যায়। মা কে তো আর ছাড়া যায় না’

সেদিন দেখলাম উত্তরার হাউজবিল্ডিং ও রবীন্দ্র স্মরণীর মাঝের ফুটওভার ব্রীজে ভাসমান মানুষগুলো ঘুমানোর একটি অভিনব পদ্ধতি বের করেছে। ব্রীজের ছাউনির নিচে কাঠামোর লোহার পাইপ ও বিমের মাঝে লোহার তারে নিজেদের পেঁচিয়ে ঘুমিছে পড়েছে ভাসমান মানুষগুলো। তারগুলো ওজনের চাপে গায়ে গেঁথে যাচ্ছে, কালসিটে পড়ে যাচ্ছে শরীরে। তবুও একটু বিশ্রাস, একটু আশ্রয় যে চাই। শহরের সস্তাতম যায়গায়ও রাত্রি যাপনেে জন্য যে টাকাটা প্রয়োজন সেটাও তারা সংকুলান করে উঠতে পারছে না।

আমাদের এই দেশটা ‘কাজ নাই’, ‘চাকরি নাই’ নামে এক মানসিক রোগে ভুগছে। এই দেশটাকে আমরা যাদের হাতে তুলে দিয়েছি তাদের কখনও ক্ষমা করতে পারবো না। শ্রেণীসংঘাতের এই অবস্থা সেই স্বাধীনতা উত্তর অবস্থান থেকেই চলে আসছে। একজনের কথা জানি, যে মাত্র তিন হাজার টাকার জন্য মিরসরাই থেকে চিটাগাং শহরে গিয়ে প্রতিদিন অফিস করে। যাওয়া আসার ভাড়া এবং দুপুরের খাবার মিটিয়ে মাস শেষে এই ছেলেটা তার বাবার হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট তুলে দেয়। ছেলেটা এক পর্যায় আসা যাবার খরচ মেটাতে অফিসের পাশে এক মসজিদে রাত কাটানো শুরু করল। এক মাস মসজিদে রাত কাটিয়ে বাবার হাতে হাজার দেড়েক টাকা তুলে দেবার যন্ত্রণা গুলো পাশ কাটিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ বলে চিৎকার করলেই সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না।

এক পরিচিত বড়ভাইয়ের কথা জানি যে অনেক মাস ধরে দুপুরে এবং রাতে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিছে। লাঞ্চ টাইমে দুইটা বন খেয়ে দুই গ্লাস পানি খেলে নাকি আট ঘণ্টা পেট ভরা থাকে। বেতনের অর্ধেক মেসে দিতে হয়। বাকি অর্ধেক মা’কে। মা পেরালাইসিস। বাবা মাছ ধরতে গিয়ে লঞ্চ ডুবে নিখোঁজ। মায়ের ওষুধ খরচ বেড়ে যাওয়াতে মেস ছেড়ে রাতে ছাউনিতে থাকা শুরু। সকালে এমন ভাবে পরিপাটি হয়ে অফিসে আসে, দেখে বোঝার উপায় নেই।

এই ছেলে গুলাকে তুমি কী সাইকোথেরাপি দিবে? এ মাসে মেসের টাকা দিতে না পারলে যাকে রাস্তায় নামতে হবে তাকে হেলাল হাফিজের কবিতার বই দিলে সে শান্ত হবে না। বাসা থেকে আর টাকা চাইবার মুখ নাই, বন্ধুরা সিগারেট ধরালে সেটা কখন দু টান দেয়া যাবে, অসুস্থ মা, এই ঈদে ভাগে হলেও গরু কিনতে হবে। মানুষের মাথায় কিলবিল করছে এরকম অসংখ্য যন্ত্রণা। গেম অফ থ্রোন্সের নতুন এপিসোডের লিংক দিয়ে এই মানুষগুলোকে খুশি করার কোন উপায় নেই। এভেঞ্জারস এন্ড গেমের স্পয়লার দিলেও এই মানুষগুলো বিষন্ন হবেনা। এদের তুমি সিনেমা হলে অস্কারপাওয়া মুভি দেখিয়ে, কে কবে কেন নোবেল পাইছে এই সব জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে কিংবা ঘোরগ্রস্ত গান শুনিয়ে শান্ত করতে পারবে না।

সত্যিকার অর্থে এই ব্যাপারটি এড়িয়ে যাবার আর কোন অপশন নেই। প্যারাসিটামলের ট্যাবলেট দিয়ে ক্যান্সারের রোগীকে সুস্থ করা যাবে না। নতুন প্রজন্ম, বিপ্লব-ট্যালেন্ট হাটের বাজার পরেও দেয়া যাবে। আগে মানুষ বাঁচাই।