পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’জন কিংবদন্তী চিত্রশিল্পীর আগমন ঘটেছে তার মাঝে লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হলে বোধহয় অতুক্তি করা হবে না। চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও ইতালীয় রেনেসাঁসের কালজয়ী এই চিত্রশিল্পী বহুমুখ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী এবং বিংশ শতাব্দীর বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য জনক লিওনার্দো নিজেই এক বিশাল রহস্যের আঁধার। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার বেশীরভাগ কাজই আর বিলুপ্ত। তবুও যেসব কাজ আমাদের কাছে রয়েছে সেসব কালজয়ী সৃষ্টির কথা বললে প্রথমেই আমাদের চিন্তায় আসে লা জোকন্দ বা মোনালিসা, এরপর আসে ভিটরুভিয়ান ম্যান, লাস্ট সপার, ভার্জিন অব দ্যা রকসের মত শিল্পগুলো। কিন্তু লিওনার্দোর আর একটি অনবদ্য রহস্য ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’।
লিওনার্দোর সৃজনে লিডাই একমাত্র নগ্নমূর্তি এবং পুরাণের উপরে আধারিত প্রথম ও একমাত্র রচনা। ইতালীয় কবি আন্তোনিও সেইনির জন্য নেপচুনের ফোয়ারার নকশা করতে গিয়েই পৌরাণিক বিষয়গুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেছিলেন লিওনার্দো। নতুবা আগে কখনও পুরাণঘটিত কাহিনীর প্রতি তার কোন প্রীতিই দেখা যায়নি।
গ্রিক পুরাণ অনুসারে লিডা ছিলেন আয়েতোলিয়ান রাজা থেস্তিয়াসের কন্যা এবং স্পার্টার রাজা তাইন্দারেউসের স্ত্রী। পুরাণমতে কোন একদিন জিউস(জুপিটার) রাঁজহংসের বেশে ছিলেন। তখন একটি ঈগল তাকে তাড়া করলে জিউস আশ্রয় প্রার্থনা করেন রানী লিডার কাছে। লিডা তাকে আশ্রয় দেন। রানী লিডার রুপে মুগ্ধ রাজহংসরূপী জিউস লিডার উষ্ণ সান্নিধ্যে আসেন এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। যে রাতে জিউস লিডার সাথে মিলিত হন সেই রাতে তাইন্দারেউসও লিডার সাথে মিলিত হন। ফলে লিডা দুইটি ডিম প্রসব করেন। একটি থেকে হেলেন এবং ক্লাইমেনেস্ত্রা জন্ম নেন অপরটি থেকে জন্ম নেন ক্যাস্টর এবং পোলাক্স। এই চার জনের মধ্যে কে জিউসের সন্তান আর কে তাইন্দারেউসের সন্তান তা কোথাও পরিষ্কার ভাবে উল্লেখিত হয়নি।
লিওনার্দো তার শেষ জীবনে যে তিনটি ছবি আঁকেন তার সবগুলোই রহস্যে পূর্ণ। এই তিনটি ছবি হল- লা জোকন্দ, লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান ও সেন্ট জন দ্য বাপিস্ট। লা জোকন্দ বা মোনালিসা’র রহস্য সন্ধানে তো ঐতিহাসিকদের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে এখনও। ধারণা করা হয় লিডা ও মোনালিসার কাজ দুইটি তিনি একই সাথে শুরু করেছিলেন। লিডা’র ছবিটিও হয়ত বর্তমান ঐতিহাসিকদের চিন্তার খোরাক জোগাতে পারত। কিন্তু রহস্যের ব্যাপার হলো লিওনার্দোর বেশীরভাগ কাজের মত ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ ছবিটিও উধাও হয়ে গেছে। কিংবা হয়ত ধ্বংস হয়ে গেছে ত্রয়োদশ লুইয়ের কোন মন্ত্রী মাদাম দা ম্যাঁতনঁর হাতে। যদিও রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের মন্ত্রী মাদাম দা ম্যাঁতনঁর নির্দেশে লিডা ধ্বংস হবার কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবী করা হয়। কারণ ১৭৭৫ সালে কার্লো গোলাদোনি বলেন মাদাম দা ম্যাঁতনঁ যে কখানি ছবিকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন সেই তালিকাতে এই ছবিটি নেই। কিন্তু রাজকীয় সংগ্রহশালা থেকে ছবিটি কি করে উধাও হয়ে গেল তার কোন হদিস নেই।
লিডার বর্ণনা করতে গিয়ে লোমাৎস বলেন,
“লিডা সম্পূর্ণ নগ্ন, রাজহাসের কন্ঠলগ্না, চোখদুটি লজ্জায় আনত।”
রুবেনস ও পুঁসার বন্ধু, সেনাপতি কাসিয়ানো দেল পোৎসো লিখেছেন যে ফঁতেনব্লোতে ১৬২৫ সালে লিডা’র ছবিটি দেখেছেন। তার বর্ণনানুসারে-
“দন্ডায়মান লিডা, প্রায় নগ্ন, রাজহাঁস, দুটি ভাঙা ডিম ও চারটি শিশু। ছবিটি কল্পনায় একপ্রকার শুষ্কতা থাকলেও, অঙ্কনে ও পরিনতিতে তা অসামান্য। বিশেষত নারীটির বক্ষদেশ। পশ্চাৎপট, উদ্ভিদ-বৃক্ষাদির অলংকরণ- সবই অতীব সুক্ষ্মতায় ও যত্নে নির্মিত। তবে ছবিটির অবস্থা বেশ খারাপ। ছবিটি তিনটি আলাদা প্যানেল জুড়ে তৈরী যার জোড়াগুলো বরাবর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছে। এতে করে ছবিটির দশা খুব খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “
১৬৯২ থেকে ১৬৯৪ সালে রাজকীয় চিত্রতালিকায় ছবিটি স্থান পায় ও ভিঞ্চির নামেই তা তালিকাভুক্ত হিসেবে দেখা যায়।পরবর্তী তালিকায় ছবিটি উধাও। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ছবিটির আর কোন হদিস পাওয়া যায় না।
আজকের দিনে ছবিটি সম্পর্কে ধারণা করার উপায় একটাই- এর বহুল অনুকরণের আঁকা কোন একটি ছবিকে দেখা। লিওনার্দোর ছাত্র ও অনুগামীদের হাতে আঁকা ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ ছবিটির কিছু অনুকরণ পাওয়া যায়। তাদের এই কাজগুলো পাওয়া যায় স্পিরিদনের সংগ্রহে, রোমের বোহের্স গ্যালারীতে আর কিছু কিছু ব্যক্তিগত সংগ্রহে। ইতালীর রেনেসাঁস যুগের অন্যতম প্রধান শিল্পী রাফায়েলের একটি অনুকৃতি পাওয়া যায় লন্ডনের উইন্ডসরে রয়েল লাইব্রেরীতে। আর লিওনার্দোর হাতের কাজ হিসেবে রয়ে গেছে কিছু স্কেচ। তার স্কেচগুলোর মধ্যে নতজানু ও দন্ডায়মান লিডা মুর্তির কিছু স্কেচ পাওয়া যায়। নেদারল্যান্ডের রোটারডামের বইজমানস ভ্যান বেইনিঙ্গেন জাদুঘরে, চ্যাটসওয়র্থের ডেভনশায়ার সংগ্রহে নতজানু লিডার কিছু স্কেচ পাওয়া যায়।.এছাড়া দন্ডায়মান লিডা’র (Leda debout) ছবি আছে লিওনার্দোর নোটবুকে জ্যামিতিক স্টাডির আশেপাশে কিছু ক্ষুদ্র স্কেচে। এছাড়াও লিওনার্দোর কোডেক্স এটল্যান্টিক্স ও ফোলিও ডি পান্ডুলিপি বি তে কিছু স্কেচ পাওয়া যায়। লুভর মিউজিয়ামে লিডার একটি স্কেচ রাখা আছে। আগে এই স্কেচটিকে লিওনার্দোর বলে ভাবা হত। কিন্তু এখন ভাবা হয় সম্ভবত অন্য স্কেচ দেখে মেলৎসির করা অনুকৃতি এটি।
‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’-এর সবচেয়ে রহস্যময় অংশ ভাবা হয় তার মাথা ও চুলের অংশটিকে। লিওনার্দো লিডা’র মুখের অভিব্যক্তি অঙ্কনে খুব অল্প শ্রমই দিয়েছেন বলে মনে হয়। মাঝের দুইটি নিম্ন মানের স্কেচ দেখে মনে হয় সে হয় মুখায়বটাকে ফাঁকাই রেখেছিলেন। পরে তার কোন ছাত্র সেটিকে এঁকে থকবে। পক্ষান্তরে লিওনার্দো তার সকল শ্রম ও মনোযোগ দিয়েছিলেন জটিল কেশদামের অঙ্কনে। স্কেচগুলোতে দেখা যায় লিডা’র চুলের বিনুনি জালবদ্ধ, অপূর্ব জটিল কেন্দ্রতিগ বলয়িত ও কুঞ্চিত কেশদামের সূক্ষ্ম চিত্রন। অন্যদিকে জিউসের প্রতিমূর্তি রাজহাঁসটি নিজেই একটি প্রতীক।
জিউস আর লিডার মধ্যকার ভালোবাসায় রাজহাঁসের প্রতিনিধিত্ব কারণ হিসেবে দেখা যায়- রাজহাঁস দীর্ঘস্থায়ী ও স্পষ্টত একগামী সম্পর্ক, বিশ্বাস ও ভালোবাসার প্রতীক। যদিও এক্ষেত্রে বিশ্বাসের ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর। কারণ লিডা একই সাথে জিউস ও তার নিজের স্বামী তাইন্দারেউসের সাথে সঙ্গমে মিলিত হয়। কিন্তু লিওনার্দো লিডাকে দেখিয়েছেন অনিচ্ছুক ও প্রতিরোধময় এক ভঙ্গিতে। পুরাণমতে জিউস একটি সাদা রাজহাঁসের রুপ নিয়ে এসেছিলেন ঠিকই। কিন্তু রাজহাঁস প্রতীকী অর্থে পুরুষ ও নারীর চরিত্রকেও প্রতিনিধিত্ব করে। কিছু সংস্কৃতিতে রাজহাঁসকে নারীর সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। তাই লিডা’র পাশে রাজহাঁস যেন তার সৌন্দর্য্যকেই নির্দেশ করে। আর জিউস লীডা’র এর সৌন্দর্য্যেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। আবার রাজহাঁস হয়ে জিউসের আবির্ভূত হওয়া ঐতিহাসিক প্রতীকী অর্থে জিউসের পৌরুষত্বকেই প্রতিনিধিত্ব করে।
লিওনার্দোর পরে তার স্কেচগুলো দেখে ষোড়শ শতকে অনেক শিল্পীই এই থিম বা চিন্তনের উপরে ছবি আঁকেন। মাইকেল অ্যাঞ্জালোর অঙ্কিত লিডা-ও পরবর্তীযুগে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভেনিসে রক্ষিত গ্রিক মর্মর ভাষ্কর্যের আদলে তিনি এ ছবিতে বিশাল দানবিক রাজহাঁসের সাথে লিডা’র সঙ্গমের দৃশ্য এঁকেছিলেন। যদিও গ্রিক ভাস্কর্যে স্পার্টান রানি লিডাকে অনিচ্ছুক ও প্রতিরোধময় ভঙ্গিতে। কিন্তু মাইকেল অ্যাঞ্জালো লিডাকে এঁকেছিলেন অবৈধ প্রনয়ের ভঙ্গিতে। প্যাশন ও কামনার চিত্রই পরিলক্ষিত হয় অ্যাঞ্জেলোর এই কাজটিতে। কিন্তু লিওনার্দো লিডাকে এঁকেছিলেন নরম পরিপূর্ণ ও পবিত্র এক তরুনীর রূপে। লিডার কন্ঠলগ্না রাজহাঁসটির গলার আকৃতি লিঙ্গের মত। সাথে এক দোলায়মান ঘন সবুজ উদ্ভিদরাজি মিশে যাচ্ছে লিডার পোশাকের সাথে। কোথাও প্রেম বা কামের উচ্ছাস ফোঁটে না। বিশাল ডিমের খোসাটি হঠাৎ আঘাত করে চেতনার উপরে। প্রশ্ন জাগে কেমন করে, কত ভয়াবহ বেদনার ভেতর দিয়ে প্রসব হয়েছে এই ডিম। সন্তান জন্মের রহস্যময় প্রক্রিয়া নিয়ে কোন সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ময় বাচনই শুধু সৃষ্টি করেনা এই ছবিটি। বরং অদ্ভুত ও বিকৃত এক আদিম তাড়িত জীবনবেগের ধাক্কা এসে লাগে। পৃথিবীর জঠর থেকে যেন কিছু একটা ফুঁড়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
এই ছবিটিতে অনেক সমালোচক কিছু একটা ভয়াবহতা খুঁজে পেয়েছিলেন। লিওনার্দো মনে, প্রাণে ও কর্মে সর্বদা ছিলেন বিজ্ঞানের পূজারী। তিনি তার সমগ্র জীবন ব্যয় করে গেছেন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে। তার আঁকা শরীরবৃত্তীয় সততা- যন্ত্রপাতি বা আস্ত্রশস্ত্রের স্কেচের বাস্তবতা এমনকি কাফকাও অস্বীকার করতে পারেননি। যেন বুদ্ধিদীপ্ত তা বিচরন করে এক স্বপ্নের জগতে। যেন জেগে জেগে এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে ভেতরে বয়ে নিয়ে চলেছেন এক যুক্তির প্রবাহ। সেই লিওনার্দো-ই কি করে বিজ্ঞানের নীতিগুলোকে ভেঙে ও পেরিয়ে কিভাবে এমন এক ছবিতে উপনীত হতে পারেন এ নিয়েই সমালোচকদের যত আগ্রহ। যিনি মোমের আলোয় পচনশীল গলিত মৃতদেহের উদর কেটে ছিঁড়ে দেখেছেন, যিনি নারীর বিশাল রহস্য নিয়ে আশ্চার্য, কম্পিত, ভীত ও তাড়িত, জননের ভীতিকর প্রক্রিয়া নিয়ে বিচলিত সেই লিওনার্দো-ই যখন জীবনের অন্তিম সময়ে এমন একটি ছবি আঁকেন তখন আমরা বুঝতে পারি তার কি বেদনা লেগে আছে এই ছবিতে! মাদাম দা ম্যাঁতনঁ যদি এই ছবিটিকে আগুনে বিসর্জন দিয়ে থাকেন তা যে ছবিটির অবৈধ প্রনয়য়ের জন্য তা নয়। হয়ত খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস ও আস্থা এই অমানুষিক ও অপৌত্তলিক প্রকৃতিবাদের ধাক্কায় ভেঙে যায় বলেই।
তথ্যসূত্রঃ
[১] Leonardo: The Artist and the Man by Serge Bramly
[২] The Life of Leonardo Da Vinci by Giorgio Vasari and Herbert Horne
[৩] Wikipedia
[৪] Europeanartincontext.blogspot.com
[৫] Discoveringdavinci.com
[৬] Royalcollection.org.uk
[৭] Leonardo-da-vinci.net