বই বিমুখ একজনকে একবার জীবনবাবুর একখানা কবিতা সমগ্র উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। তার কিছুদিন পর দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করলাম কবিতা কেমন লেগেছে। উত্তরে সে বললো, “কবিতাগুলো ঠিক বিকেলের মত।” আমার মনে হলো একজন কবির কবিতা সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার চেয়ে একজন কিশোরের কাছে বিকেল হয়ে ওঠাটা অনেক বেশি গুরুত্ববহন করে।

জ্বী তিনিই জীবনানন্দ’, একজন কমলালেবু, বাংলা সাহিত্যের জগতে সবচেয়ে অবহেলিত কিন্তু সর্বাপেক্ষা প্রহেলিকাময় পুরুষ। অথচ এই পৃথিবীর বুকে আজন্মকাল প্রচন্ড অন্তর্মুখী এই মানুষটি পেয়েছেন শুধুই অবহেলা। জীবদ্দশায় দেখেছেন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ; নিজের জীবনে দেখেছেন প্রেম-অপ্রেম; পেয়েছেন উপেক্ষা। জটিল, স্তরান্বিত, ব্যতিক্রমী, কমপ্লেক্স সমন্বিত, অনিশ্চয়তাবোধে আক্রান্ত, অন্তর্মুখী, কিছুটা ডিপ্রেসিভ, একাকীত্ব পীড়িত, দ্বন্দ্বদীর্ণ, আধুনিম মনের এই মানুষটিকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হইচই হয়নি তেমন কখনও-ই । আঁন্দ্রে জিদের উদ্ধৃত করে তিনি যে বলেছিলেন “আমি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখি না বরং তারও পরের প্রজন্মের জন্য লিখি” তারই পরিস্ফুটন ঘটতে দেখা যাচ্ছে ইদানীংকালে। মানুষ বুঝতে শুরু করেছে তার গভীরতা।

অথচ পৃথিবীর মানুষ একদিন ভেবেছিলো, তিনি এসেছিলেন, এরপর ফিরে গেলেন বালিগঞ্জ ডাউন ট্রামে চেপে। তারা জীবনকালে কোনদিন স্বীকারই করলো না কী করুণ জীবনচক্র সবুজ ঘাস, নদী আর জোনাকির দেশ বরিশাল থেকে তাঁকে নিয়ে ফেলছিল ল্যান্সডাউন রোডের সেই ১৮৩ নম্বর বাড়িতে, আদিম বিষাক্ত সর্পিনী ট্রাম লাইনের উপরে। তিনি কি জানতেন- কতটা চমৎকার ছিলেন তিনি? কতটা প্রহেলিকাময় ছিলেন? আচ্ছা তিনি কি কখনও ঘাস হতে পেরেছিলেন? কিংবা ঘাসের ঘ্রান হরিৎ মদের মত গেলাসে গেলাসে পান করতে পেরেছিলেন? তিনি কি জানতেন অনেকদিন হলো তাঁর বিরহে পৃথিবীর মানুষেরা নিজেদেরকে আক্ষেপের সমুদ্রে বন্দী করেছে? এ থেকে কারো নিস্তার নেই। কারণ ধূসর পান্ডুলিপি যে লেখা হয়ে গেছে সমস্ত আকাশজুড়ে।

সেই আক্ষেপ থেকে পরিত্রান পেতেই হোক কিংবা তার প্রহেলিকা চিত্তে ধারণ করেই হোক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান গভীরভাবে খুঁজে পান বিপন্ন বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে তাকানো, ট্রামের ক্যাচারে আটকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া প্রথম এবং শেষ মানুষ জীবনানন্দ দাশকে। জীবনানন্দ দাশ নিয়ে তার দীর্ঘ পড়াশুনার ফলস্বরূপ লিখে ফেলেন ‘একজন কমলালেবু।’ ‘একজন কমলালেবু’র পেছনে গ্রন্থপঞ্জি ঘাটলে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আজ পর্যন্ত লেখা উল্লেখযোগ্য কোন বইয়ের উপজীব্যই বাদ যায়নি। তিনি সাবলীল্ভাবে উপস্থাপন করেছেন জীবনের ভালো-মন্দ, আশা-নিরাশার দোলাচলে আলাদাভাবে দোল না খেয়ে দ্বৈধতাকে সত্য মনে করা জীবনানন্দ দাশের জীবনের দ্বৈততাকে। পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’ শোভনার মিলুদাকে, লাবন্যের অপদার্থ পতিকে।

জীবনানন্দ যেন শাহাদুজ্জামানের কষ্টিপাথর। সেই কষ্টিপাথরে ঘঁষে তিনি আরো অমোঘ গভীরে স্পন্দন দিতে চেয়েছেন তার সার্থক সাহিত্যের প্রশ্নগুলোকে। তিনি নিজেই বলেছেন"এই বই লিখতে গিয়ে জীবনানন্দের মতো এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে অভূতপূর্ব একটা সময় কেটেছে আমার। টের পেয়েছি, আজকের পৃথিবীতে কী দুর্দান্তভাবে প্রাসঙ্গিক তিনি, জেনেছি লেখক হিসেবে নতজানু হয়ে কত কিছু শেখার আছে তাঁর কাছে। ফরাসি লেখক গুস্তাফ ফ্লবেয়ার তাঁর বন্ধু আর্নেস্ত ফেদিউকে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কখনো আমাকে নিয়ে কোনো বই লেখো তাহলে এমনভাবে লিখবে, যেন তুমি আমার হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছ।’ প্রতিশোধ? কার বিরুদ্ধে? জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লিখতে গিয়ে যেন একটু একটু করে বুঝেতে পেরেছি ফ্লবেয়ার আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন।" কিন্তু হাজার বছরের পথ হাঁটা, এই অন্ন ও যৌনতা ভরা পৃথিবীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার স্পৃহা, সাহস, রুচি হারানো, টেম্পোরারি সাসপেনশন অব ডিজবিলিভে আক্রান্ত জীবনানন্দ দাশের রহস্য কি তিনি বুঝতে পেরেছেন? বুঝতে পেরেছেন কি তাঁর প্রহেলিকা?

 


বই সম্পর্কিত তথ্যাবলীঃ নাম: একজন কমলালেবু

লেখক: শাহাদুজ্জামান 

প্রকাশনী: প্রথমা প্রকাশন 

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৪০