মূল বিষয়ে যান

মধুমেলায় - যশোর

·5 মিনিট
ভ্রমনপঞ্জি

আমি বরাবরই একটু ভ্রমনপ্রিয়। তবে আমার ঘোরাঘুরির ধ্যান-ধারনা অন্য সবার থেকে একটু আলাদা। যেমন- ঘুরতে বের হয়ে খাবার-দাবার কিংবা বিলাসী জীবনের উপর আমি সবসময়ই উদাসীন। সে কারনেই হোক কিংবা আমার অন্তর্মূখী হওয়ার কারণেই হোক আমার বেশীরভাগ ভ্রমনই হয় একা একা। যদিও এবারে ভাগ্যক্রমে একজন সঙ্গী পেয়ে গিয়েছিলাম।

গত বছরের মানে ২০১৬’র প্রথম দিকের কথা। একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম যশোরের সাগরদাঁড়িতে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯২তম জন্মদিন উপলক্ষে ২২ জানুয়ারী থেকে মধুমেলা শুরু হতে যাচ্ছে। চলবে ২৮ জানুয়ারী পর্যন্ত। এমনিতেই যশোর কখনো যাওয়া হয়নি, তার উপর এমন সাঁজ সাঁজ রব। লোভ সামলাতে পারছিলাম না। সেমিস্টার শুরু হয়েছে মাত্র। চাপও একটু কম। ভাবলাম একবার ঘুরে আসতে পারলে মন্দ হত না। প্লান করতে শুরু করলাম কিভাবে কি কর যায়? বৃহঃস্পতি-শনি তিনদিন সাপ্তাহিক ছুটি। ২৭ জানুয়ারী বুধবার ক্লাস শেষ করে যদি রওনা দেই তবে ২৮ জানুয়ারী মেলার শেষদিন ঘুরে দেখা যাবে। সাথে আরও একদিন অন্য কোথাও না হয় ঘুরে আসা যাবে।

একা একা যাবো? এমন করতে করতেই একদিন ফেসবুকে দেখলাম একজন পোস্ট দিয়েছে সেও যেতে চায় কিন্তু একা ভরসা পাচ্ছে না। তার সাথে যোগাযোগ করলাম। নাঈম (ছদ্মনাম। কিছু ব্যক্তিগত কারণে আসল নাম ব্যবহার করতে পারছি না)। তারপরেও যাবো কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ২৭ তারিখ দুপুরে। নাঈম ভাইকে ফোন করে বললাম দুইটা টিকেট করে রাখার জন্য। বাস রাত ৯ টায়। মালিবাগ থেকে। আমার ক্লাস শেষ হবে বিকাল ৫ টায়।

তখন আমি সিদ্ধেশ্বরী থাকি। ৫ টায় ক্লাস শেষ করে বনানী থেকে সিদ্ধেশ্বরী পৌঁছাতেই ৭ টা বেজে গেলো। কোন রকম ব্যাগ গুছিয়ে সাড়ে ৮ টার মাঝে পৌছে গেলাম মালিবাগ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যাকে টিকেট করতে বলছি তার সাথে কোন পরিচয়ই নেই। দেখিও নাই কখনও। তাও অপেক্ষা করতে করতে ৯ টা বাজার ১০ মিনিট আগে নাঈম ভাই এসে হাজির। বাস ছাড়লো ৯ টা ১০ এ। নাইম ভাইয়ের সাথে পরিচিত হলাম। তখন সে ঢাবি থেকে অনার্স শেষ করে বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আমার অনেক সিনিয়র।

ঢাকা ছাড়িয়ে আমাদের বাস চলতে শুরু করল ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে ধরে। আরিচা ঘাটে যখন পৌছালাম তখন রাত ১২ টা। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। ফেরীতেই খাওয়া - দাওয়া সেরে নিলাম। এরপর কোথায় খাবো, কোথায় থাকবো জানি না। কারণ আমার প্লেন কোন হোটেল ছিলো না। প্লান ছিলো ৩ রাতে কোন হোটেল নেই। রাতগুলো বাসেই কেটে যাবে। আরিচা ফেরী পার হয়ে বাস যখন চলতে শুরু করল তখন চোখে একটু ঢুলুনি ভাব এলো। মনে হলো ঘুমিয়ে নেয়াই ভালো। আমাদের প্লান ৬ টার দিকে বাস আমাদের নামিয়ে দেবে ঝিকরগাছা। এরপর আমরা যাবো গতখালী ফুলের বাগান দেখতে। কিন্তু আমাদের অনুমানের অনেক আগেই রাত সাড়ে ৩ টার দিকে শ্যামলী বাস আমাদের নামিয়ে দিলো ঝিকরগাছা। একে তো হাড় কাঁপানো শীত। তারউপর এতরাতে সম্পূর্ণ অচেনা এক শহরে কোথায় যাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রাস্তার পাশে দেখলাম এক টং এর মামা চুলোয় মাত্র আগুন জালাচ্ছে। আশ্রয় নিলাম সেখানেই। সেই আগুনের পাশে বসে নিজেকে একটু গরম করে নিলাম। সাথে সেই মামার কাছ থেকে সবকিছু জেনে সারাদিনের প্লান সাজাচ্ছিলাম।

৬ টার দিকে যখন একটু একটু করে সূর্যি মামা লাল আভা ছড়াচ্ছিলো তখন ৫০ টাকায় ভ্যান ভাড়া চলে গেলাম ফুলের বাগান দেখতে। রাস্তায় যাওয়ার পথেই চোখে পড়ছিলো উচু উচু করে বোঝাই করা ভ্যানভর্তি রজনীগন্ধা আর গোলাপ। কুয়াশা ঢাকা সরু পীচঢালা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মধ্য দিয়ে। তার দু’পাশে গোলাপ, রজনীগন্ধা আর শত শত রকমের ফুলের বাগান। মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে খেজুর গাছ।

ফুলের বাগান ঘুরে যখন গতখালী বাজারে ফিরে এলাম তখন বাজারের রমরমা অবস্থা। কয়েকশত পাইকারী ব্যবসায়ী ফুল কিনতে এসেছে। এই ফুলগুলোই সন্ধ্যার মাঝে পৌছে যাবে শাহবাগে। গোলাপ দেখলাম ৫০০ টাকা করে ‘শ বিক্রি হচ্ছে। গতখালী বাজারেই সকালের নাস্তা সেরে পাশেই চারাতলা গ্রামে পাখিদের অভয়ারণ্যে ঘুরে এলাম। এর মধ্যেই সাড়ে ১০ টা বেজে গেছে। এবার আমাদের বের হয়ে পড়া উচিত মধুমেলার উদ্দেশ্যে। কারন ঝিকরগাছা থেকে কেশবপুর অনেকটা দূর।

গতখালী বাজার থেকে অটোরিক্সায় করে রেলব্রীজের নিচে আসলাম। এখানেই প্রথম দেখা কপোতক্ষ নদী। সেই নদী আজ আর নেই। তবে এখানকার লোকের মুখ থেকে শুনলাম মাইকেল (স্থানীয়রা এই নামেই সম্ভোধন করে থাকে) ও তার পরিবার এই নদী দিয়েই বজরা নিয়ে যাত্রা করতেন। নদী আজ একেবারেই মরে গেছে। রেলব্রীজের নিচ থেকে নছিমনে (এক ধরনের ইঞ্জিনচালিত ভ্যান) করে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য রাজবাড়ী। সেখান থেকে ত্রিমোহনী। আর সেখান থেকে সাগরদাঁড়ি। রাজবাড়ী যাওয়ার রাস্তা এতোটাই ভালো(!) যে পেটের ভেতর যা ছিলো সব হজম হয়ে গেছে এর মধ্যেই। রাজবাড়ী এসে পৌছালাম বেলা সাড়ে বারটার দিকে। রাজবাড়ী থেকে আবার নছিমনে করে পৌছালাম ত্রিমোহনী। ত্রিমোহনী থেকে মোটরবাইক নিয়ে যখন সাগরদাঁড়ি মধুপল্লীতে পৌছালাম তখন দুপুর দেড়টা। পেটের মাঝে চো চো করছে। চারপাশের মেলার দিকে কোন খেয়ালই ছিলো না। বাইক থেকে নেমেই কোন মতে পেটে চালান করে দিলাম ভাত আর ডিম।

খাওয়ার পরে পেট বাবাজি যখন একটু শান্ত হলো তখন চারপাশে তাকিয়ে আমি মুগ্ধ। মধুসূদন দত্তের বাড়ির সামনের পুরোটা রাস্তা আর বিশাল মাঠ জুড়ে মূল মেলার আয়োজন। মাঠের মাঝ বরাবর চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমেই ঢুকলাম মধুসূদন দত্তের বাড়ি, মধুপল্লীতে। জাদুঘরে।

কবির ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরোটা। কবির সমাধি রয়েছে বাড়ির পেছন দিকটায়। যদিও প্রচন্ড ভীড়ের কারণে একটু অসুবিধায় পড়তে হয়েছিলো।

মধুপল্লী থেকে বের হয়ে গেলাম মূল মেলার মাঠে। কিছুক্ষণ বসে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখলাম। আর দশটা গ্রাম্য মেলার মতই এখানে আছে মোয়া-মুড়কি থেকে শুরু করে মেয়েদের প্রসাধনী। মেলায় আসছি আর কিছু কিনব না তা তো আর হয়না। ২০০ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম একটা হাতে তৈরী হ্যামক।

ঐদিনই ছিলো মেলার শেষদিন। বিকাল ৫ টা বেজে গেছে। এবার ফেরার পালা। হাতে সময় আছে ২ দিন। ঢাকায় ফিরবো নাকি থেকে গিয়ে আশেপাশের কোন এলাকা ঘুরে দেখব সেই চিন্তা করছিলাম কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারছিলাম না। ভাবলাম আগে বাসস্ট্যান্ড যাই। এরপর যে বাস পছন্দ হয়ে সেটায় উঠে পড়ব। শেষবারের মত কপোতক্ষ নদের কবির বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বাইকে উঠে পড়লাম নাইম ভাইকে নিয়ে। উদ্দেশ্য কেশবপুর। সেখান থেকে বাসে করে মনিহার বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টার দিকে কেশবপুর পৌছালাম। কেশবপুর থেকে বাসে উঠলাম। বাস আমাদের নামিয়ে দেবে মুড়ালী। মুড়ালী থেকে যেতে হবে মনিহার বাসস্ট্যান্ড।

বাসস্ট্যান্ড যখন পৌছালার তখন রাত ৯ টা। রাতে খাবার খেতে খেতে ভাবতে থাকলাম কোথায় যাওয়া যায়। পাশের টেবিলে বসে খাচ্ছিলো এক দম্পতি। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিলো তারা যাবে নাটোর। ব্যস! মাথার মধ্যে ঢুকে গেলো বনলতা। আধাঘন্টার মধ্যে নাইম ভাইকে নিয়ে নেট ঘেটেঘুটে মোটামুটি একটা প্লান করে ফেললাম। পরের যাত্রা নাটোর।

Related

আরণ্যক ও একটি স্বপ্নময় রাত
·7 মিনিট
ভ্রমনপঞ্জি অরণ্য
দিগন্ত রেখায় কালা পাহাড়
·6 মিনিট
ভ্রমনপঞ্জি পাহাড়ি