অনেককেই বলতে শুনি, তারা পাহাড়ে যান মেঘের সিংহাসনে বসে নিচের পৃথিবীর সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে। কিন্তু একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী? সে কেন পাহাড়ে যায়? তার দু চোখে তো তুলোর মত উড়ে যাওয়া মেঘ কিংবা ঐ শুভ্র সাদা তুষার চূড়া কিছুই ভাসে না। হাওয়াদের দ্বারা ভারি কুয়াশাদের ঝেটিয়ে নিয়ে যাওয়া, রাত ফুরোনোর আগেই শুরু হয়ে যাওয়া আলোর নাটক এসব কিছুই তার চোখে ধরা দেয় না। পৃথিবী জুড়ে তার শুধুই অন্ধকার। তবুও কেন সে পর্বতারোহন করে? জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকে কিসের নেশায়? নিজের প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই করে সাত মহাদেশের উচ্চতম পর্বত চূড়া অর্থাৎ সেভেন সামিট সম্পন্ন করা এমন একজন পর্বতারোহী হলেন এরিক ভিয়েনমায়ার।

অকুতোভয় ও অঘটনঘটনপটিয়সী এরিক ভিয়েনমায়ারের জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর আমেরিকার অঙ্গরাজ্য নিউজার্সিতে। নিউজার্সিতে জন্ম গ্রহণ করলেও বাবা মা ও দুই ভাইয়ের সাথে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে হংকং ও ওয়েস্টনে। শিশু অবস্থা থেকেই তার চোখে সামান্য সমস্যা ছিল। তার বাবা মা তাকে সে সময়ে চিকিৎসা করালে ডাক্তাররা জানান তার রেটিনায় সমস্যা আছে এবং সম্ভবত কৈশোরে পদার্পণের আগেই সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবে। তখন থেকেই তিনি পুরু চশমা ধারণ করা শুরু করলেন। বাবা মায়ের যথেষ্ট পরিচর্যার মাঝ দিয়েই তিনি আস্তে আস্তে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে লাগলেন। কিন্তু ১৩ বছর বয়সে রেটিনোসিসিস নামক রোগে তার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে। এমনকি প্রথম দিকে হাঁটাচলার জন্য লাঠি ব্যবহার করতে এমনকি ব্রেইল ভাষা শিখতেও অস্বীকৃতি জানাতেন। হার মানাকে হারিয়ে দিয়ে একসময় তিনি ঘুরে দাঁড়ান। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এরিক চেয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তিহীন জীবনের মাঝেই জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে। তখন থেকেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলেন বিশ্বজয়ের।

এরিক শৈশবে ফুটবল খেলতে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। এরপর দৃষ্টিশক্তির সাথে সাথে খেলাধুলা করার ক্ষমতাও যখন তার চলে গেলো তখন তিনি মনোনিবেশ করলেন কুস্তীগিরিতে। সেখান থেকেই তার প্রথম সাফল্য ধরা দিল। প্রথমবারের মত তিনি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করেন। ন্যাশনাল ফ্রিস্টাইল রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহন করার পরে তিনি বলেন,

“বাস্তবিক ভাবেই রেসলিং আমার জীবনকে পরিবর্তণ করে দিয়েছে। এই প্রথমবার কোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে আমি লড়ছি যেখানে আমার প্রতিদ্বন্দী আমার থেকে বেশী শক্তিশালী।”

তখন থেকে তার কিশোর মনে ধারণ করতে শুরু করলেন যেকোন বাধাই অতিক্রম করতে পারবেন। নিতান্তই হীনমন্যতায় ভুগে পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য তার জন্ম হয়নি। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ থাকতে পারে তবে তার মত একটা মানুষও নেই। তিনি বুঝতে পারলেই চুড়া থেকে নিচের দিকে তাকালে শুধু পরে যাওয়ার দৃশ্যই মাথায় আসবে। তার লক্ষ্য রাখতে হবে ঊর্ধ্বে। নিজেকেই টেনে নিয়ে যেতে হবে সেই চুঁড়ায় যেখান থেকে তিনি তার লক্ষ্যকে শূণ্যে ছুড়ে দিতে পারবেন।

১৬ বছর বয়সে তিনি উইজার্ড নামের একটি কুকুরকে নেভিগেট করার জন্য গাইড হিসেবে বেছে নেন। এই সময় থেকেই তিনি ‘অ্যারিজোনা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে’র একটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ক্যাম্পে রক ক্লাইম্বিং শেখা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি লক্ষ্য করেন যে চোখ ছাড়াও স্বাভাবিকের মতই শুধুমাত্র হাত ও পায়ের মাধ্যমে তিনি আরোহণ করতে পারছেন। এক সময়ে তার দক্ষতা এতটাই বেড়ে যায় যে ক্যাম্পের সবাই তাকে ‘বানর’ ডাকতে শুরু করে। অ্যারিজোনা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে প্রশিক্ষনরত অবস্থায় তার দক্ষতায় ক্যাম্পের সবাই যখন পঞ্চমুখ তখন তার মনোবল আরো বেড়ে গেলে, লক্ষ্যে আসলো দৃঢ়তা। ভালোবেসে ফেলতে শুরু করলেন রক ক্লাইম্বিংকে। তারই স্পষ্টতা পাওয়া যায় তার কথায়-

“আমার মনে হচ্ছে আমি রক ক্লাইম্বিংকে ভালোবেসে ফেলেছি। কারণ একটি বড় পাথর সবসময়েই স্থির থাকে। এটি গতিশীল নয়, বরং সর্বদা উর্ধ্বগামী আর একারণেই আমি সহজেই নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে পারি।”

এখান থেকেই শুরু। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন পর্বতের মায়াজালে। পাহাড়ের দর্শনে শিহরিত হতে থাকে সমস্ত রোমকূপ। চোখ দিয়ে ছুয়ে দেখলেই নিরন্তর শূণ্যতা দেখতে না পান, কান পেতে শোনা শুরু করলেন প্রকৃতির নিজস্ব সঙ্গীত। সেই থেকে নিরন্তন ছুটে চলেছেন এক পর্বত থেকে আরেক পর্বত।

১৯৯১ সালে তিনি বোস্টন কলেজ থেকে ইংলিশ ও কমিউনিকেশনের উপর ডাবল মেজর নিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্সের জন্য ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে অন্ধত্ব ও পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকার কারণে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। দাঁতে দাঁত চেপে সকল প্রত্যাখান সহ্য করে গেছেন তিনি। তিনি জানতেন জীবনে যুদ্ধ করতে গিয়ে সবাইকেই অবহেলিত হতে হয়। তবে সবাই অপমান গুলোকে ‘জেদ’ এ পরিণত করতে পারে না। তিনি পেরেছিলেন। দুই বছর বাদে লেসলে কলেজ থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি আমেরিকার অ্যারিজোনার ‘ফনিক্স ডে স্কুল’এ কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। একই স্কুলের কুস্তীগিরির কোচও ছিলেন তিনি। এই সময়ে তার মা গাড়ী দূর্ঘটনায় মারা গেলে এরিক প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন।

বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান প্রেরণা গর্ভধারীনিকে হারিয়ে, পৃথিবীর সমস্ত রূপসুধা ইদ্রিয়গোচর করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া এরিকের মনে তীব্র ভয় ও বেদনা জন্ম নেয়। তিনি ভাবতে থাকেন এবার বোধহয় তার বাবাও তাতে ছেড়ে চলে যাবে। তার নতুন মা হয়ত বাধ্য করবে তার বাবাকে। দৃষ্টিশক্তি ও মাকে হারিয়ে একরকম নিসঙ্গ হয়ে পড়েন। তিনি চাইতেন বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও গল্পগুজবে মেতে থাকতে। কিন্তু একসময় বন্ধুরাও এই জড় পদার্থের ন্যায় প্রতিবন্ধী বন্ধুটিকে পরিত্যাগ করা শুরু করল। তিনি ভয় পেতে শুরু করলেন- একসময় হয়ত তিনি আর এই পৃথিবীর কোন কাজেই আসবেন না। এসব অন্তর্লীন বেদনা তাতে শক্ত করে তোলে, নিগুঢ় দুঃখের বেড়াজাল ভেদ করে তিনি বেরিয়ে আসতে চাইতেন প্রতিনিয়ত। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে তিনি ফিরে যান সেই পর্বত, নির্মল প্রকৃতি ও রোমাঞ্চের দুনিয়ায়।

সেই সময় বাবা ও ভাইয়ের সাথে তিনি পেরু, স্পেন, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউ গিনিতে ট্রেকিংয়ে যান। এরপর তিনি তাজিকিস্তানে পামির মালভূমি ট্রেক করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অবসরে তিনি বেশ কিছু স্থানীয় পাহাড় আরোহণ করেন। ১৯৯৩ সালে কারাকোরাম রেঞ্জের বাতুরা গ্লেসিয়ার অতিক্রম করেন। ১৯৯৫ সালে ফনিক্স ডে স্কুলে শিক্ষকতার সময়েই তিনি উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট ডেনালি (৬,১৯০ মিটার) আরোহণ করেন।

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি। ধাক্কা খেয়ে বের হয়ে লাইট বন্ধ করে হা হুতাশ করাটা সহজ। ধাক্কাটাকে দাঁত চিপিয়ে জেদ বানানোটাই কঠিন। এরিক বিশ্বাস করেছিলেন যারা এটা পারে তারাই সফল হয়। তাইতো নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাত্র বিশ বছর বয়সে পর্বতারোহী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ২০০৮ সালে নিউ গিনি’র ‘কার্টসটেঞ্জ পিরামিড’ আরোহণের মাধ্যমে সে তার সেভেন সামিট সম্পন্ন করেন। তিনি শুধু একজন সফল পর্বতারোহীই নন। তিনি একজন সফল ক্রীড়াবিদ, অভিযাত্রী, লেখক, মোটিভেশনাল স্পিকার।

শুধু তাই নয়। ‘The Nose of El Capitan’ পাথরের এক খাড়া দেয়াল যাকে একসময় আরোহণ করা অসম্ভব বলে মনে করা হত সেটিও তিনি সফল ভাবে আরোহণ করেন। ২০০৮ সালে তিনি মাত্র ২ দিন ৩ ঘণ্টায় ২৭০০ ফুটের খাড়া বরফ ‘লোসার’ আরোহণ করেন। তার জীবনের এইসব কঠোর চ্যালেঞ্জিং, রোমাঞ্চে ভরপুর অভিজ্ঞতা নিয়ে একের পর এক লিখে গেছেন টাচ দ্য টপ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড, অ্যাডভার্সিটি অ্যাডভানটেজ, টার্নিং এভরি ডে স্ট্রাগলস ইনটু এভরিডে গ্রেটনেস নামের অসাধারণ সব বই। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘সাফল্য শুধুমাত্র একটি চরম মুহূর্তই নয় যেটা শেষ লক্ষ্যে পৌঁছানো কিংবা চূড়ায় উঠে পতাকা তুলে ধরাকেই বুঝায়। বরং সাফল্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি প্রক্রিয়া যেটা কখনও কখনও ব্যর্থতা থেকেও হতে পারে।’

সাত মহাদেশের উচ্চতম চূড়াগুলো আরোহণে এরিকের যাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণী-

• মাউন্ট ডেনালি (৬,১৯৪ মিটার):

ফনিক্স ডে স্কুলে শিক্ষকতার সময়ে ১৯৯৫ সালের জুনে তিনি সেভেন সামিটের প্রথম সামিট হিসেবে মাউন্ট ডেনালি আরোহণ করেন। স্থানীয় আথাবাস্কান ভাষায় ডেনালী অর্থ ‘মহান’। তার অভিযান শুরু হয়েছিল ৪০ মাইল দীর্ঘ আর ১ মাইল প্রস্থ কাহিটিনা হিমবাহ থেকে। ডেনালির অন্যন্য বৈশিষ্ট হিসেবে তিনি উপলব্ধি করেছেন বেইজ ক্যাম্প থেকে চূড়া পর্যন্ত এর এলিভেশন গেইন। ডেনালির বেইজক্যাম্প সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২০০০ ফুট উচ্চতায় যেখানে চূড়ার উচ্চতা ২০,৩২০ ফুট। বেইজক্যাম্প থেকে যেটা এভারেস্টের এলিভেশন থেকে অনেক গুন বেশি।

• কিলিমানজারো (৫,৮৯৫ মিটার):

১৯৯৭ সালের আগস্টে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পরে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে ২য় অভিযানে সফল হন তিনি। দ্বিতীয় অভিযানে সে চার মহাদেশের কিছু দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিলিমানজারো সৃষ্টি হয়েছে মূলত বৃহদাকার অগ্নুৎপাতের কারনে। একারণেই এই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে এখনও সালফারের গন্ধ পাওয়া যায়। যদিও চূড়াটি বিষুবরেখায় অবস্থিত কিন্তু এটি সবসময়েই বরফাচ্ছাদিত থাকে। কিলিমানজারোর সামিট অবস্থিত কালডেরার সাউথ এইজে। এই পর্বতের অন্য নাম ‘উহুরু’ সোয়াহিলি ভাষায় যার অর্থ ‘স্বাধীনতা’।

কিলিমানজারো তার কাছে সর্বদাই একটু বেশিই স্বতন্ত্র আর অন্তরঙ্গ। কেননা এখানেই ১৩,০০০ ফিট উচ্চতায় তিনি তার সঙ্গীকে বিয়ে করেন। তখন তার স্ত্রীর কোন বিয়ের পোষাকই ছিল না। তার বন্ধুরা পাহাড়ি ফুল আর পাথরের স্বমন্বয়ে ফুলের তোড়া তৈরি করে নব দম্পতি কে উপহার দেন। এভাবেই তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়।

• অ্যাকনকাগুয়া (৬,৯৬১ মিটার):

১৯৯৭ সালের প্রথমবার অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৯৯ সালের দ্বিতীয় অভিযানে তৃতীয় চূড়া হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত অ্যাকনকাগুয়া আরোহণ করেন। আর্জেন্টিনায় অবস্থিত আন্দিজ পর্বতমালার এই পর্বতচূড়াই দক্ষিণ গোলার্ধের সর্বোচ্চ বিন্দু। অনেক পর্বতারোহীই এই পর্বতটিকে ধাতুর স্তুপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারন বেশিরভাগই ট্যালুস বা ঢালু খণ্ড খণ্ড বলের মত পাথরগুলো একটি উপরে আর একটি অবিন্যস্ত অবস্থায় আছে। আর এটা সত্যিই একজন অন্ধ পর্বোতারোহীর জন্য সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন। কারণ প্রতিটি পদক্ষেপেই কোন দৃঢ়তা নেই। অ্যাকনগুয়া সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত এর নিষ্ঠুর বাতাসের জন্য। প্রথম অভিযান ব্যর্থ হয়েছিলো সামিট থেকে মাত্র ১৮০০ ফুট নিচে থেকে। কারণ তীব্র বাতাসের কারণে তারা একে অপরের চিৎকার পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলেন না। এক বছরের একটু বেশী সময়ের ব্যবধানে তারা আবার অভিযান চালিয়ে সফল হন।

• মাউন্ট ভিনসন (৪,৮৯২ মিটার):

মাউন্ট ভিনসন পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন চূড়া। দক্ষিণ আমেরিকার সর্ব দক্ষিণ প্রান্ত পুণা এরিনাস থেকে সি-১৩০ কার্ফো প্লেনে ৬ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে তারা প্যাট্রিয়ট পাহাড়ে পৌঁছেন। শীতের সময়ে (ফেব্রুয়ারি-অক্টোবর) এই ক্যাম্পটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। এখানে তাপমাত্রা এতটাই শীতল যে মাঝে মাঝে তা পঞ্চাশ ডিগ্রী ফারেনহাইটেও নেমে যায়।

সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল সামিটের নিচেই একটি সরু পাথুরে রিজ। শেষ মুহূর্তে তার পায়ে খিল ধরে যাচ্ছিল। ঠোট ঠাণ্ডার তীব্রতায় নীল হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সব প্রতিবন্ধকতাকে পরাজিত করে ২০০০ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সামিট হিসেবে এন্টার্টিকা মহাদেশের সেনটিনেল রেঞ্জে অবস্থিত মাউন্ট ভিনসন আরোহণ করেন।

• মাউন্ট এভারেস্ট (৮,৮৪৮ মিটার):

হিলারী ও তেনজিংয়ের দেখানো সাউথ কল রুট ধরে এরিক তার সেভেন সামিটের পঞ্চম সামিট হিসেবে ২০০১ সালের ২৫ মে মাউন্ট এভারেস্ট সামিট করেন। এভারেস্টের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন এরও ২ বছর আগে থেকে। এই দুই বছর ধরে তিনি বিভিন্ন রকম শারীরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এভারেস্ট অভিযানের পূর্বে অনেক পর্বতারোহী তাঁকে বলেছিলেন অতিউচ্চতার বরফ অনেক শক্ত হয়। তুমি তোমার আইস অ্যাক্স দিয়ে সেসব যায়গায় তোমার পতন ঠেকাতে পারবে না। তাছাড়া ২৬,০০০ ফুটের উপরে ডেথজোনে তোমার মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজও করবে না। তোমার এভারেস্ট অভিযান বাতিল করা উচিত।

প্রতি উত্তরে তিনি বলেছিলেন,

‘তারা আমাকে বিচার করেছিল একটি মাত্র জিনিসের ভিত্তিতে আর তা হলো আমার অন্ধত্ব। কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারেনি যে দৃষ্টিশক্তি ছাড়াও আমার মাঝে আরও প্রায় ডজনখানেক বৈশিষ্ট্য আছে যা একজন ভালো পর্বোতারোহীর থাকা প্রয়োজন।’

পূর্বের অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্ত্বেও তিনি বিশ্বাস করতেন কোন পর্বতেরই প্যাটার্ন এক রকম নয়। প্রতিটি পর্বতই গঠন ও বৈশিষ্টে স্ব স্ব মহিমায় আলাদা। খুম্বু আইসফল এলাকাকে তার এভারেস্ট অভিযানের সবচেয়ে কঠিনতম অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন,

“আমি পরিশ্রমের পর পরিশ্রম করে গেছি। কিন্তু আমি জানি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছানোই মূল সাফল্য নয় যেখানে মাত্র কয়েক ফুট নিচের খাদে পড়ে যাওয়াই চূড়ান্ত ব্যর্থতা। আমি পর্বতারোহণকে নিতান্তই একটা খেলা হিসেবে না নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নিয়েছিলাম।”

• মাউন্ট এলব্রুস (৫,৬৪২ মিটার):

এরিক ২০০২ জালের জুনে তার ষষ্ঠ সামিট হিসেবে মাউন্ট এলব্রুস আরোহণ করেন। মাউন্ট এলব্রুসের অবস্থান ককেশাস পর্বতমালায়। এটি ইউরোপ মহাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া হলেও এ নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। এটি ইউরোপিয়ান রাশিয়া আর এশিয়ার জর্জিয়ার মাঝে অবস্থিত। অনেকে ১৫,৭৮১ ফুটের মাউন্ট ব্যাঙ্ককে ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত মনে করেন। কারণ এটি পশ্চিম ইউরোপ থেকে ইরানের কাছে অবস্থিত। মাউন্ট এলব্রুস তার ভয়ঙ্কর আবহাওয়া এবং ঝলকানি বাতাসের কারণে বেশি পরিচিত। এই আবওহাওয়া থেকে উত্তোরনের একমাত্র উপায় ব্যারেল আকৃতির কুটিরগুলো।

• মাউন্ট কসসিউসকো (২,২২৮ মিটার):

অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে অবস্থিত গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জের কসসিউসকো সেভেন সামিটের মধ্যে সবচেয়ে কম কষ্টসাধ্য চূড়া, মাত্র একদিনের হাইকিং পিক। ২০০২ সালের আগস্টে এরিক ও তার দল কসসিউসকো আরোহণ করেন। মাউন্ট এলব্রুস এবং মাউন্ট ব্লাঙ্কের মত এই পর্বতচূড়া নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। ডিক বাস এর মূল সেভেন সামিট তালিকা অনুসারে কসসিউসকোকে অস্ট্রেলীয়া মহাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু যেহেতু মহাদেশের সর্বজনীন গৃহীত কোন সংজ্ঞা নেই তাই রেইনহোল্ড মেসনার তার তালিকায় নিউ গিনির কার্টসটেঞ্জ পিরামিডকে সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারণ মাউন্ট কসসিউসকো একটি সহজ ট্রেকিং পিক যেখানে কার্টসটেঞ্জ পিরামিড অসাধারণ চ্যালেঞ্জিং। এরিক তাই দুটো চূড়াই আরোহণের সিদ্ধান্ত নেন। অস্ট্রেলিয়া খুবই রুক্ষ, শুষ্ক ও সমতল মহাদেশ। তা স্বত্তেও কসসিউসকোতে শীতকালে তুষারপাত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এরিক ও তার দল এজন্যই কসসিউসকোর চূড়া থেকে স্কি করে নেমে আসেন।

• কার্টসটেঞ্জ পিরামিড (৪৮৮৪ মিটার):

ইন্দোনেশিয়ার বিচ্ছিন্ন নিউ গিনিতে সুদিরমান রেঞ্জে অবস্থিত কার্টসটেঞ্জ পিরামিডকে মেসনার তার তালিকায় সেভেন সামিটে স্থান দেন। তাই এরিক তার সেভেন সামিটের সর্বশেষ সামিট হিসেবে ২০০৮ সালের আগস্টে এটি আরোহণ করেন।

কার্টসটেঞ্জ পিরামিড হিমালয় ও আন্দিজ পর্বতমালার মধ্যকার সবচেয়ে উচু খাঁজকাটা ও তুষারাবৃত একটি চূড়ো। এর শীর্ষে লাইমস্টোনে গঠিত ২০০০ ফুটের উল্লম্ব প্রাচীর রয়েছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে খনির কম্পানিগুলো টুরিস্টদের এখানে যেতে দিতো না। ১০০ জনের মত পর্বোতারোহী তাদের সেভেন সামিটে কার্টসটেঞ্জ পিরামিড সামিট করেছেন। কার্টসটেঞ্জের নিচের জঙ্গলে একটি মারাত্মক সংঘর্ষ্পূর্ণ সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান। সেখানে এখনও আদিম অধিবাসীরা গাছের পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারন করে তীর ধনুক নিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে আধা সামরিক বাহিনীরা কাঁধে একে-৪৭ নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। সেখানে এরিকের মত হাই টেকনোলজির গিয়ার আর স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে যাওয়া পর্বতারোহীরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

শুধুমাত্র সেভেন সামিট শেষ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, শুধুমাত্র নীল-সাদার স্বপ্নেই বিভোর থাকেননি। অ্যাডভেঞ্চারের সকল শাখায় রয়েছে তার বিস্তর পদচারণা। অ্যাডভেঞ্চারের পোকা সবসময়েই তার মাথায় কুটকুট করতে থাকে। সেভেন সামিট শেষ করে তিনি খুঁজতে ছিলেন কিছু ভিন্নতার স্বাদ। তখন তিনি মনোনিবেশ করেন অ্যাডভেঞ্চার রেসিং, কায়াকিং, স্কি, আর সাইকেলিংএ। ২০১১ সালে ৩ সদস্যের দল নিয়ে তিনি ‘এক্সপিডিশন ইম্পসিবল’ নামের আমেরিকান টিভি রিয়েলিটি সিরিজে মরোক্কোর তপ্ত মরুভুমি ও পর্বতের উপর রেসে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এছাড়া তিনি লিডভেল এর ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় ১০০ মাউন্টেন বাইক রেস, ৪৬০ মাইল ও ৬০,০০০ ফুট এলিভেশন অর্জন করার প্রাইমাল কোয়েস্ট রেসও সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি তার সহযাত্রী লনি বেডওয়েলকে সাথে নিয়ে কলোরাডো নদী ধরে গ্রান্ড ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে ২৭৭ মাইল কায়াকিং করেন। কায়াকিং এর এই অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশ করেন ‘অ্যা ব্লাইন্ড ম্যান’স জার্নি টু কায়াক দ্য গ্রান্ড ক্যানিয়ন ‘ এছাড়াও এরিক পৃথিবীর আরো বেশ কিছু দুরূহ পর্বতও আরোহণ করেন।

এরিক ভিয়েনমায়ার শুধু একজন সফল পর্বতারোহীই নন। তিনি পর্বতারোহণের পাশাপাশি সমাজের জন্য, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নির্বিকারভাবে। ২০০৪ সালে সাব্রি তেনবারকেন ও ছয়টি তিব্বতীয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে নিয়ে তিনি এভারেস্টের নর্থ সাইড আরোহণ করেন। সেখানে তারা ২১,৫০০ ফুট আরোহণ করেন যেটা এ পর্যন্ত যেকোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। তাঁদের এই অভিযানের বর্ণনা নিয়ে পরিচালক লুসি ওয়াকার ২০০৬ সালে ‘ব্লাইন্ডসাইট’ নামে একটি ১০৪ মিনিটের সিনেমা তৈরি করেন। যেটা ২০০৭ সালে বার্লিন ফ্লিম ফেস্টিভাল, ২০০৮ সালে ‘টরেন্টো ফ্লিম ফেস্টিভালে’ প্রদর্শন করা হয়।

এছাড়াও ‘তোমার পথে কি আছে তার চেয়ে তোমার ভেতরে কি আছে সেটা অধিক বেশি শক্তিশালী’ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে ২০০৫ সালে ‘নো ব্যারিয়ার ইউএসএ’ নামে একটি সংগঠনের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আহত সৈনিকরাই এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন শারীরির সকল প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেও জীবনকে কতটা সুন্দরভাবে উপভোগ্য করে তোলা যায়।

 

ছবি: এরিক ভিয়েনমায়ারের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত।

তথ্যসূত্র:

[১] http://touchthetop.com/about-erik

[২] https://en.wikipedia.org/wiki/Erik_Weihenmayer

[৩] http://edition.cnn.com/2016/05/11/health/turning-points-erik-weihenmayer/index.html

[৪] http://www.k2news.com/erik.htm

দ্রষ্টব্যঃ প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম অদ্রি-তে প্রকাশিত হয়।