এই তো সেদিনের কথা। সকাল ৮ টা ১০ মিনিট। বনানীর আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর ক্যাম্পাস ৭ এর লিফটের সামনে ঘুরঘুর করছি। ঠিক ঘুরঘুর না, ৭০৮৩ রুম খুজছি। লিফটের সামনে একজনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপু, ৭০৮৩ রুমটা কোথায় বলতে পারবেন?” তিনি আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন -৭০৮৩ মানে ক্যাম্পাস-৭ এর ৮ম তলার ৩ নম্বর রুম। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, " ফিজিক্স ক্লাস? যাও ক্লাসে যাও আসতেছি।" ক্লাসে গিয়ে বসার মিনিট পাঁচেক পরে দেখি লিফটের সামনের সাহায্য করা, সাথে ভার্সিটিতে প্রথম ক্রাশ খাওয়া আপুটিই বিখ্যাত রুতাবা জানিয়া ম্যাম। মনটা গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে ম্যাম নিজের পরিচয় দিলেন- কোন এক আর্মি অফিসারের স্ত্রী এবং তার একটি বাচ্চাও আছে।
এরপর কোথায় কোথায় দিয়ে যেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আজ ছিল আন্ডারগ্রাজুয়েটের সর্বশেষ ক্লাস। স্বভাবতই আমার কষ্ট হওয়ার কথা। ভার্সিটির চেয়ার, টেবিল থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, ক্যাম্পাস সবকিছুই আমাকে স্মৃতিকাতর করে দেয়ার কথা। পক্ষান্তরে আনন্দিত হওয়ারও কথা। দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি, ল্যাব, সিটি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, মিড, ফাইনালের পীড়াদায়ক কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের আনন্দ।
কিন্তু সত্যি বলতে কি আমার কষ্ট বা আনন্দ কিছুই হচ্ছে না। পিছনের বছরগুলোর দিকে ফিরে দেখলে আমি শুধু দেখতে পাই একরাশ হতাশা। প্রথমত ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একটা বিশাল সিজিপিএ তোলা ছাড়া আমার আর কোন অর্জনই নাই। একসময় বড়ভাই বোনদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নামক রূপকথার গল্প শুনে যে একটা ছবির নেগেটিভ কপি হৃদয়ে লালন করেছিলাম, ডার্করুমে নিয়ে সেই ছবির রঙিন প্রত্যাবর্তন কখনোই ঘটেনি। গত চার বছরে অর্জনের তালিকা দেখলে তলানিতেও কিছু পাওয়া যাবে না। না পেয়েছি একটা ফ্রেন্ড সার্কেল, না ছিল আমার কোন অ্যাক্টিভিটি। প্রতিদিন সকালে ঘুম ঘুম চোখে ক্যাম্পাসে যাওয়া, একের পর এক বিরতিহীন ক্লাস করা, ক্লাস শেষে লোকালবাসে ঝুলে ঝুলে বাসায় ফেরা। এই ছিল দৈনন্দিন রুটিন। কিন্তু আমারও ইচ্ছা করত ছাতা ক্যান্টিনে বসে জমজমাট আড্ডায় সিগারেট পোড়াতে, সেমিস্টার ব্রেকে দলবেঁধে ঘুরতে যেতে, কারো কারো সাথে ঝগড়া করতে আবার কাঁধে হাত দিয়ে পথ চলতে, ভালোবাসতে। কিন্তু আফসোস আমি কিছুই করতে পারিনি, কিছুই না।
অবশ্য আমার এই নিঃসঙ্গতার জন্য, একাকীত্বের জন্য কাউকে দায়ী করা মোটেই সমীচীন বলে মনে করি না। নিজের অন্তর্মুখিতার জন্য নিজের চারপাশেই অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী করে তার ভেতরে নির্বাসিত করে রেখেছি। কারো দায় পড়েনি সেই প্রাচীর টপকে ভেতরের মানুষটিকে দেখার। আমারই দোষ; আমি পাড়িনি হৈ-হুল্লোড়ে যোগ দিতে, নিজের সত্ত্বাকে, নিজের জীবনবোধকে বিলিয়ে দিতে। যুগ যুগান্তরে চলে এসেছি যে প্রথার বিপ্রতীপে সেই প্রথাগত সামাজিকতা রক্ষা করতে আমি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। তাই মেনে নিয়েছি- এটাই বাস্তব দুনিয়া এবং এটাকে মেনে নিয়েই আমি সুখী। আমি বলব না সমমনা না হলেই বন্ধু হওয়া যায় না। কিংবা আমার সমমনা কেউ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। আমি অথর্ব, খুঁজে পাইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেও আমার তেমন কোন সম্পর্ক কখনোই তৈরী হয়নি। আমার মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্ক শুধুই ব্যবসায়িক। কিন্তু তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নিয়ম ভাঙছি বলে আমার মনে পড়েনা, খুব অসুস্থ না হলে কখনো ক্লাস মিস দিয়েছি এমনও হয় নাই কখনও। চেষ্টা করেছি সর্বাত্মক নিয়মানুবর্তি থাকতে। এজন্য মূল প্রেরণা ছিল কয়েকজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি মহান কয়েকজন শিক্ষাগুরু পেয়েছি এটা ঠিক। তারা আমার কাছে সর্বদা অনুসরণীয়। শিক্ষকদের মত মহান মানুষদের বিচার করার মত বোধশক্তি আমার এখনও হয়নি। তাই আমার স্বল্পজ্ঞান দিয়ে আমি তাদের বিচার করতে পারবো না।
তোমার দ্বারা শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি মানুষও হোক নতুন প্রজন্ম; এই প্রত্যাশায়- বিদায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ।
-১৮ এপ্রিল, ২০১৮
ফিচার ছবিঃ ভাস্কর দেব